সিসিএন ডেস্ক : আলোচিত সগিরা মোর্শেদ হত্যার বিচার পেতে ৩৫ বছরের অপেক্ষা আরো বাড়লো৷ বৃহস্পতিবার রায়ের কথা থাকলেও বিশেষ দায়রা জজ মোহাম্মদ আলী হেসাইন ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন তারিখ দিয়েছেন৷ বাদীর আইনজীবী ফারুক আহমেদ জানান, ‘‘রায় প্রস্তুত না হওয়ায় বিচারক সময় নিয়েছেন৷ আমরা ৩৫ বছর অপেক্ষা করেছি৷ আরো কয়েকটা দিন না হয় অপেক্ষা করব৷”
এমন আরো অনেক মামলার বিচার পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়৷ এর কারণ কী?
সগিরা মোর্শেদ হত্যার তদন্তে ৩১ বছর
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে রিকশা যোগে আনতে গিয়ে অজ্ঞাত ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ তারপর দীর্ঘ সময় এই মামলার তদন্ত চলে ভিন্ন পথে৷ তদন্তকারীরা ধারণা করেছিলেন তিনি মটরসাইকেলে আসা ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন৷ পুলিশ ওই মামলায় মন্টু ও মারুফ রেজা নামে দুইজনকে শনাক্ত করে৷ আবাসন ব্যবসায়ী মারুফ রেজা তখনকার এরশাদ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে হওয়ায় তাকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয়া হয়৷ আদলতে মামলার সাক্ষ্য চলাকালে মারুফ রেজার নাম আসায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়৷ আর সেই আদেশ নিয়ে আইনি লড়াই শেষে ২০১৯ সালের জুন মাসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে(পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেয় হাইকোর্ট৷ পিবিআই ঘটনার দিন সগিরা মোশের্দকে বহনকারী সেই রিকশাচালককে ৩০ বছর পর খুঁজে বের করে হত্যাকাণ্ডের জট খোলে৷ ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি তারা আদালতে চার্জশিট দেয়৷ জানা যায়, নিজ পরিবারের কয়েকজন তাকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করিয়েছে৷ এই মামলার আসামিরা হলেন-সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, জা সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন, শ্যালক আনাছ মাহমুদ রেজওয়ান, মারুফ রেজা ও মন্টু ৷ স্ত্রীর কথায় প্ররোচিত হয়ে ছোট ভাইয়ের বউকে শায়েস্তা করার জন্য ২৫ হাজার টাকায় সে সময় বেইলি রোড এলাকার ‘সন্ত্রাসী' মারুফ রেজাকে ভাড়া করেছিলেন ডা. হাসান৷ মারুফকে সহযোগিতার জন্য স্ত্রীর ভাই রেজওয়ানকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন৷
আরো কয়েকটি উদাহরণ
সগিরা মোর্শেদ হত্যার বিচার পেতে ৩৫ বছরে অপেক্ষা৷ এরমধ্যে তদন্তেই কেটেছে ৩১ বছর৷ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি৷ তিনবার তদন্ত সংস্থা বদলের পর একযুগ ধরে মামলাটির তদন্ত করছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন( র্যাব) আদালতের নির্দেশে৷ এপর্যন্ত ১০৭ বার সময় নিয়েও তারা কোনো তদন্ত অগ্রগতি রিপোর্ট দিতে পারেনি৷ চিহ্নিত করতে পারেনি হত্যাকারীদের৷ বিচার তো অনেক দূরে একযুগে তদন্তই শেষ হয়নি৷ আইনমন্ত্রী বলেছেন, এই মামলা তদন্তে ৫০ বছর সময় লাগলেও তা দিতে হবে৷ আইনমন্ত্রীর কথার জবাবে সাগরের মা সালেহা মুনির বলেছেন, ‘‘৫০ বছর পর আমরা কেউই থাকব না৷ যারা হত্যা করেছে তারাও থাকবে না৷ তাহলে কার বিচার করা হবে? কার জন্য বিচার করা হবে?”
২০০০ সালের ১ জুলাই ঢাকার পশ্চিম হাজীপাড়ার বাসায় খুন হয়েছিলেন সিটি কলেজের অনার্সের ছাত্রী রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা৷ ওই মামলায় ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর পুলিশ চার্জশিট দেয়৷ ২০০৩ সালের ৩০ জুন মামলার রায়ে বুশরার সৎ ভাই কাদের, শ্যালক শওকত ও কবিরকে মৃত্যুদণ্ড এবং কাদেরের স্ত্রী রুনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ কিন্তু আপীলে ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে আসামীরা সবাই খালাস পান৷ এর প্রতিক্রিয়ায় বুশরার মা লায়লা ইসলাম তখন বলেছিলেন,"এখন মনে হয়, বুশরা বলতে কেউ জন্মগ্রহণই করেনি৷ বুশরা নামে কেউ ছিল না, কেউ খুনও হয়নি৷”
শুধু এই তিনটি ঘটনা নয় হত্যাকাণ্ডের মত ফৌজদারি অনেক মামলাই তদন্তের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে৷ আর তদন্ত শেষে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর দেখা যায় অধিকাংশ মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়ে যান৷
কক্সবারের চকরিয়া উপজেলার বিএস চর বেতুয়া গ্রামে শিশু শিশু রিপা মনিকে হত্যা করা হয় ২০০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি৷ ওই মামলায় দ্রুতই চার্জশিট দেয়া হলেও গত ২১ বছর ধরে চলছে তন্তের বৈধতা নিয়ে লড়াই চরলছে আদালতে৷ এখন ওই লড়াই চলে গেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে৷ আর এই লড়ায়ের কারণে মামলাটির বিচার শুরু হচেছ না৷
তদন্ত ঠিক সময়ে ঠিক মতো কেন হয় না
মামলার তদন্ত, বিচার, সময়ক্ষেপণ এবং দুর্বল তদন্ত নিয়ে তদন্তকারী, সাবেক বিচারক, আইনজীবী ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে এখানে সাধারণ কিছু কারণ আছে৷ আর তা হলো তদন্তকারীদের অদক্ষতা, তদন্তে মনোযোগ দিতে না পারা এবং বিচারকের সংকট৷ তবে এর বাইরে সরকারের প্রভাব, অর্থের প্রভাব , দুর্নীতি এবং আইনের নানা প্যাঁচ৷ শেষের সব কারণগুলোই ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা ব্যবহার করতে পারে৷ তাদের লক্ষ্য থাকে মামলা তদন্ত পর্যায়েই শেষ করে দেয়ার৷ সেটা না পারলে তদন্ত দীর্ঘায়িত করা৷ তদন্ত দীর্ঘায়িত হলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়৷ আলমত নষ্ট হয়ে যায়, সাক্ষী পাওয়া যায়না৷ ফলে বাদী বিচারে তার পক্ষে রায় পাননা৷ আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়৷ আবার সেটা না পারলে দুর্বল চর্জশিট দাখিল করানো হয়৷ তাতেও আসামি সুবিধা পায়৷
প্রতিবেদনে যে চারটি মামলার কথা বলা হয়েছে তাতে ওই কারণগুলোর প্রভাব স্পষ্ট৷ সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মুনির মনে করেন, ‘‘এই সরকার সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত চায় না বলেই হত্যাকারীরা চিহ্নিত হচ্ছে না৷ মামলা তদন্তও শেষ হচেছ না৷” তাই তিনি মনে করেন তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হবে না৷
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ অনেক জটিল মামলার তদন্তকারী সিআইডির সাবেক ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘‘তদন্ত যত দেরি হবে বিচার পাওয়াও তত কঠিন হবে৷ কারণ তদন্তে দেরি হলে আলামত, সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়৷ সাক্ষীরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে৷”
তার কথা, ‘‘সিআইডি এবং যারা বিশেষভাবে তদন্তে নিয়োজিত তারা যত গভীরভাবে কাজ করেন থানা পুলিশ সেভাবে করেনা৷ একজন সাব ইন্সপেক্টর তদন্ত করেন ওসি সাহেক দেখে দেন৷ কিন্তু তদন্ত করে যদি সঠিকভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ না করা হয়৷ তারপর সেটা ঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন না করা হয় তাহলে বিচারে গিয়ে ফল পাওয়া যায় না৷ ফলে অনেক মামলায় শেষ পর্যন্ত শাস্তি হয়না৷ রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা হত্যায় সব আসামির খালাস পাওয়ার কারণ দুর্বল তদন্ত হতে পারে৷”
তার কথা, ‘‘অদক্ষতা তো আছেই তার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত না করার বিষয়ও থাকে৷ আধুনিক তদন্তের সব সুবিধা সিআইডিতে আছে৷ থানা পুলিশ চাইলে তার সহায়তা নিতে পারে ৷ তবে খুব একটা নিতে দেখিনি৷”
সংকট কোথায়
বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলায় সর্বোচ্চ ১৫ ভাগে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা যায় এবং শাস্তি হয়৷ আর সর্বোচ্চ আদালতসহ সব আদালত মিলে ৪০ লাখ মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছে৷ নতুন কোনো মামলা বিচারের জন্য না গেলেও যে বিচারক আছেন তাদের এই মামলা নিস্পত্তি করতে ১৬ বছর লাগবে৷ দেশের নিম্ন আদালতে ২০ বছর ধরে ঝুলে আছে এমন মামলার সংখ্যা ২০২২ সালে ছিলো ছয় হাজার ৬৮১টি৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রজমান কার্জন বলেন, ‘‘আদালতের পিপিরা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পান৷ তাদের বড় একটি অংশ অদক্ষ এবং দুর্নীতিপরায়ণ৷ আর তদন্তকারীরাও অদক্ষতার পাশাপাশি দুর্নীতিগ্রস্ত৷ অনেক সময়ই এই দুই পক্ষ মিলে অর্থের বিনিময়ে মামলা দুর্বল করে দেয়৷ অথবা ঝুলিয়ে রাখে৷ আর আইনজীবীরা প্রভাবশালীদের পক্ষ নিয়ে আইনের নানা ফাঁক খুজে তদন্ত আটকে দেয়, দীঘায়িত করে৷ আবার তারা বিচারও দীর্ঘায়িত করে৷ মামলা নিয়ে তখন বাদীকে বিভিন্ন আদালতে ঘুরতে হয়৷”
তার কথা,"পুলিশে যারা তদন্ত করেন তাদের এর বাইরেও অনেক কাজ করতে হয়৷ সে কারণেও তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে চলে৷ আইনে মামলার তদন্ত শেষ করার জন্য সময় নির্ধারিত থাকলেও তা মানা হয়না৷ আর বিচারকের সংখ্যা কম বলে মামলা জটলেগে যায়৷”
সরকারের দানবীয় ক্ষমতা
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না কয়েকটি মামলার উদাহরণ দিয়ে বলেন,"অদক্ষতা, তদন্তে ত্রুটি তো আছে৷ কিন্তু সাগর-রুনি, কল্পনা চাকমা, রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ, যশোরের শামসুর রহমান, উদীচীর মামলার ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? সেগুলোর কী অবস্থা হয়েছে৷ এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নাই৷ ওগুলোর বিচার হবে কবে?”
আর সাবেক জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘সরকার হচ্ছে এমন এতটা শক্তি, এটা হলো দৈত্য দানবের মতো৷ তারা যা চায় তাই করিয়ে নিতে পারে৷ ফলে কোনো মামলা সরকার যদি মনে করে প্রভাবিত করতে পারে৷ আর বিচারক, তদন্তকারী এদের সংকট তো আছেই৷ দেশে এখন ১০ হাজার বিচারক প্রয়োজন৷”
তিনি বলেন, ‘‘ক্ষমতা অর্থ সব কিছু দিয়ে তদন্ত প্রভাবিত করা যায়৷ দেশে তো কোনো ক্ষমতাশালীর বিচার হতে দেখিনি৷ আর গরিবে গরিবে মামলা হলে পুলিশের মেজাজ মর্জির ওপর তদন্ত নির্ভর করে৷”
তার কথা, ‘‘মামলার তদন্ত দীর্ঘায়িত করতে পারলে মামলা দুর্বল করা যায়৷ এই কাজে আইনজীবীরাও সহায়তা করে৷ আর কিছু মিথ্যা মামলাও আছে যেগুলো জমিজমার কারণে হয়৷”