শেয়ার বাজার

এসএসসিতে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি: জিপিএর বদলে বর্ণ

এসএসসিতে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি: জিপিএর বদলে বর্ণ
শিক্ষা

সিসিএন ডেস্ক : পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নে জিপিএ পদ্ধতি উঠিয়ে সাত স্কেলে মূল্যায়ন হবে৷ সেই স্কেলগুলোর বাংলা নামও নির্ধারণ করা হয়েছিল৷ কিন্তু সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নাম নয় ইংরেজি বর্ণ দিয়ে তা নির্ধারণ করা হবে৷

তবে সেই বর্ণগুলো কী হবে তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবির) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান৷ তিনি বলেন, এটা ইংরেজি বর্ণ দিয়ে নির্ধারণ করা হলেও বর্তমানে প্রচলিত নম্বরের ভিত্তিতে যে গ্রেডিং সিস্টেম আছে সেরকম হবে না৷

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যা থাকছে

মূল্যায়নের জন্য ৬৫ শতাংশ ওয়েটেজ হবে লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে এবং ৩৫ ভাগ ওয়েটেজ হবে কার্যক্রমভিত্তিক, যেটা সরাসরি যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ওপর থাকবে৷

কোনো শিক্ষার্থী যদি ৭০ শতাংশ কর্মদিবস ক্লাসে উপস্থিত না থাকে তাহলে সে পাবলিক পরীক্ষা দিতে পারবে না৷ আর আগের মতো টেস্ট পরীক্ষা থাকবে না৷ এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসের ভিত্তিতে৷

কোনো শিক্ষার্থী যদি এসএসসি পরীক্ষায় এক বা দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হয় তাহলে শর্তসাপেক্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পাবে৷ তবে তাকে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বিষয়ে পাস করতে হবে৷ আর তিন বা তার বেশি বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হলে একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না৷

লিখিত ও কার্যক্রমভিত্তিক এই দুই ভাগে মূল্যায়ন হলেও প্রশ্নের ধরন এখনকার মতো থাকছে না৷ কার্যক্রমভিত্তিক, যেমন অ্যাসাইনমেন্ট করা, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান করা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে হবে লিখিত অংশের মূল্যায়ন৷ শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনেই এখনকার মতো কেন্দ্রভিত্তিতে হবে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন৷

একেকটি বিষয়ে পাঁচ ঘণ্টা পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও এটা আরো একটু নমনীয় করার জন্য সোমবারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ প্রতিটি বিষয়ে এক স্কুল দিবসে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে৷

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবির) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা তো আগেই মূল্যায়নের জন্য সাত মাত্রার স্কেল নির্ধারণ করেছিলাম৷ এর সর্বনিম্ন ছিলো ‘প্রারম্ভিক’৷ আর সর্বোচ্চ ‘অনন্য’৷ কিন্তু এখন বলা হচ্ছে যে, যদি কেউ বলে আমার বাচ্চা ‘অর্জনমুখী’ পেয়েছে৷ তাহলে অনেকে বুঝবে না৷ তারা বলবে এটা কী? নম্বর কতো? কারণ এখানে তো কোনো নম্বর থাকবে না৷ তাই এটাকে আরেকটু কম্যুনিকেটিভ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ আগে যেমন এ+ ছিলো সর্বোচ্চ নম্বর৷ এখন সেটাকে ‘এ’ দিয়ে বোঝালে মানুষ বুঝতে পারবে যে এটা সর্বোচ্চ নম্বর৷ আগে আমরা স্কেলের সাতটি ঘর পূরণ করে দেয়ার কথা বলেছিলাম৷ যার যত ঘর পূরণ হবে সে অনুযায়ী তার ফল হবে৷ এখন সাত ঘর পূরণ হলে ধরেন ‘এ’ হবে৷ সর্বোচ্চ ফল এটা৷’’

তিনি জানান, ‘‘এগুলো ইংরেজি বর্ণ দিয়েই নির্ধারণ করা হবে৷ তবে বর্ণগুলো এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷ আর মূল্যায়ন পদ্ধতি আগের যে সিদ্ধান্ত ছিলো সেরকমই হবে৷’’

আগে গ্রেডিং গুলোর নাম দেয়া হয়েছিলো অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক৷ সর্বোচ্চ স্কেল ‘অনন্য’ বলতে শিক্ষার্থীর সব বিষয়ে পারদর্শিতার চূড়ান্ত স্তর৷ প্রারম্ভিক স্তর পারদর্শিতার সবচেয়ে নিচের স্তর৷ এখন শুধু এই নাম পরিবর্তন হবে৷

‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১’ অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে৷ চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হয়েছে৷ ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এটি চালু হবে৷ তার সঙ্গে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি৷

শিক্ষার্থী ও অভিভাকরা যা বলছেন

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি এখন যারা নবম শ্রেণিতে পড়েন তাদের জন্য৷ তারা এখন নতুন পাঠক্রমে পড়ছেন৷ যখন এসএসসি পরীক্ষা দেবেন তাদের মূল্যায়ন হবে নতুন পদ্ধতিতে৷ তারা আবার যখন এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন সেই সময় থেকে এইচএসসিতে নতুন মূল্যায়ন চালু হবে৷ 

ঢাকার আইডিয়াল স্কুলের নবম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী সাকিব আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা নতুন পাঠক্রমে পড়া শুরু করেছি৷ মূল্যায়ন নিয়ে আমরা এখনো কিছু বুঝতে পারছি না৷ শুনেছি জিপিএ নাকি থাকবে না৷ স্যাররাও আমাদের ঠিক মতো কিছু বলতে পারছেন না৷’’ 

একই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় ঢাকার আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে৷

ঢাকার একজন অভিভাবক রেজাউল আহমেদের দুই সন্তান অষ্টম এবং নবম শ্রেণিতে পড়ে৷ তার সন্তানেরা নতুন পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘নতুন পাঠক্রমের বইগুলো আমি দেখেছি৷ শিক্ষকরা যদি বইগুলো ঠিক মতো পড়াতে পারেন তাহলে বইগুলো আমার কাছে ভালোই মনে হয়েছে৷ কিন্তু মূল্যায়ন পদ্ধতি আমি নিজেই বুঝতে পারছি না৷ আমার সন্তানরাও এটা নিয়ে অন্ধকারে আছে৷ এটা আসলে আরো স্পষ্ট করা প্রয়োজন৷ আর বারবার মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করলে বিভ্রান্তি বাড়ে৷’’

তার কথা, ‘‘স্কুলের শিক্ষকদের হাতে ৩৫ নাম্বারের মূল্যায়ন কোচিংকে আরো উৎসাহিত করবে৷ সরকার যে কোচিং থেকে বেরিয়ে আমার কথা বলছে সেটা সম্ভব হবে না৷ যদি ধরেও নিই যে শিক্ষকরা ন্যায় আচরণ করবেন তারপরও আতঙ্ক থেকে যাবে বাংলাদেশের প্রচলিত সংস্কৃতির কারণেই৷ আমার সন্তানরাও এটা নিয়ে আতঙ্কিত৷’’

দাউদকান্দির আরেকজন অভিভাবক নুরুন্নাহার খন্দকার বলেন, ‘‘সিস্টেমটা হয়তো ভালো৷ কিন্তু আমরা অভিভাবকরা বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি না৷ আসলে এটা শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবক সবাইকে ভালেভাবে বুঝাতে হবে৷’’

আর স্কুলের শিক্ষকদের হাতে মূল্যায়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী তো কোচিং ব্যবস্থা দূর করার কথা বলেছেন৷ কিন্তু এতে পরিস্থিতি কী হবে তা বুঝতে পারছি না৷’’

বাংলাদেশ শিক্ষার্থী অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারবে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি৷ কিন্তু বুঝতে কত দিন লাগে আর সেই সময়ে কী হয় তাই দেখার বিষয়৷ এখন শিক্ষার্থী তো দূরের কথা শিক্ষক, অভিভাবকরাই বুঝতে পারছেন না৷ সবাই একটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন৷ শিক্ষার্থীরা রীতিমতো আতঙ্কে আছে৷’’

‘স্বর্ণ এবং চাল মাপার পাল্লা এক নয়’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘‘মূল্যায়নের গ্রেডিং স্তর যত বাড়বে তত ভালো৷ এতে মূল্যায়ন অধিকতর সঠিক হয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো দক্ষতা ও অবকাঠামোর৷ শিক্ষকরা এই মূল্যায়নের জন্য সবাই দক্ষ কিনা৷ তাদের প্রশিক্ষণ দিলেও তারা কত দ্রুত আয়ত্ত করতে পারবেন বলে মনে হয় না৷ ফলে হিতে বিপরীতও হতে পারে৷’’

তার কথা, ‘‘যে পাল্লা দিয়ে চাল মাপবেন, সেই পাল্লা দিয়ে কি স্বর্ণও মাপবেন? সেটা তো হবে না৷ সঠিক মূল্যায়নে সঠিক পাল্লা দরকার৷ পাল্লা ঠিক না করে মূল্যায়ন শুরু করলে সঠিক মূল্যায়ন হবে না৷’’

তার কথা, ‘‘শিক্ষকদের হাতে যে মূল্যায়নের ভার তা সঠিক করতে হলে ছাত্রসংখ্যা প্রতি ক্লাসে কম থাকতে হয়৷ কিন্তু আমাদের এখানে গড়ে ৭০-৮০ জন করে৷ ফলে সঠিক মূল্যায়ন হবে বলে মনে করি না৷ এখানে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এমনকি শিক্ষকদেরও প্রভাব থাকতে পারে৷ আমরা কি সেই নৈতিক মান অর্জন করেছি?’’

‘‘আগেও দেখেছি, ধরেন বায়োলজির ১০০ নম্বরের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় যে ছাত্র ২২ নম্বর পেয়েছে সে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ২৫ নম্বরের মধ্যে ২৪ পেয়েছে৷ সেটা কীভাবে সম্ভব? এটা আমাদের মনে রাখতে হবে৷ সেই পরিস্থিতি যেন আবার না হয়,’’ বলেন তিনি৷

তার মতে, আরো অনেক বিষয় আছে৷ যেমন পাঁচ ঘণ্টার পরীক্ষা৷ শহর আর গ্রামের স্কুলের মধ্যে শিক্ষক ও অবকাঠামোর পার্থক্য এগুলো বুঝতে হবে৷