একটি দেশের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শেয়ারবাজার একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বিনিয়োগকারীদের কাছে তাদের শেয়ার বিক্রি করে মূলধন বাড়াতে ব্যবসার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে।
শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে উত্থাপিত অর্থ ব্যবসার দ্বারা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ, তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করতে এবং নতুন কর্মচারী নিয়োগের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি, ঘুরে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করে।
শেয়ার কিঃ
শেয়ার হচ্ছে একটি কোম্পানীর মালিকানার অংশ। এটি কোম্পানীর পুঁজির অংশও বটে। একটি কোম্পানীর অনুমোদিত মূলধনকে সমান অংশবিশিষ্ট কতগুলো ছোট ছোট অংশে ভাগ করা হয়। মূলধনের এই প্রতিটি ক্ষুদ্র একককে একেকটি শেয়ার বলে।
এক্ষেত্রে প্রতিটি শেয়ারের মূল্যমান সমান হয় এবং এর একটি নির্দিষ্ট আংকিক মুল্য বা ফেস ভ্যালু (Face Value) থাকে। ধরুন একটি কোম্পানীর মোট মূলধনের পরিমান ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকা। এ পরিমাণকে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) অংশে ভাগ করা হলে প্রতি অংশে ১০ টাকা পড়ে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে প্রতি অংশের শেয়ারের মূল্য হবে ১০ টাকা।
এসকল শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমেই এর ক্রেতাগণ কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডার (Share Holder) বা মালিকানা স্বত্ব লাভ করেন।।
শেয়ার বাজার কিঃ
বাজার অর্থ আমরা বুঝি যেখানে বিভিন্ন পন্যের কেনা বেচা করা হয়। সে অর্থে যে বাজারে শেয়ার কেনা বেচা করা হয় সেটাই শেয়ার মার্কেট বা পুঁজি বাজার। সাধারণ বাজারে বিভিন্ন দামের বিভিন্ন ধরনের পন্যের কেনা বেচা হয় কিন্তু শেয়ার বাজারে শুধুমাত্র শেয়ার, বন্ড বা ডিভেঞ্চার তথা একটি কোম্পানীর মূলধন সংক্রান্ত চুক্তিপত্র কেনা বেচা বা লেনদেন করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের দুটি স্থানে শেয়ার বাজারের কেনাবেচা হয়, একটি হল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও অপরটি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।
শেয়ার কত প্রকার ও কী কী?
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা ও বিনিয়োগ সুবিধার্থে কোম্পানী বিভিন্ন প্রকারের শেয়ার ইস্যু করে থাকে। বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে বর্তমানে দুটি ক্যাটাগরিতে শেয়ার লেনদেন হয়ে থাকে, এর একটি হলো প্রাইমারি বা আইপিও (IPO), অন্যটি হলো সেকেন্ডারি। প্রত্যেক বছর বেশ কিছু কোম্পানি IPO (ইনিশিয়াল পাবলিক অফার) দিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
একটি কোম্পানি যখন প্রথমবারের মতো বাজারে প্রবেশ করে বা শেয়ার বাজারে ছাড়ে তাকে প্রাইমারি শেয়ার বলে। প্রাইমারি শেয়ার একবার বাজারে বিক্রি হয়ে গেলেই তা সেকেন্ডারি হয়ে যায়।
তখন সেটা সেকেন্ডারি মার্কেটে চলে আসে। তখন সেই শেয়ার সেকেন্ডারি শেয়ার বলে গণ্য করা হয়। সেকেন্ডারি মার্কেটে আপনি ইচ্ছামতো শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন। নিম্মে পাঠকের সুবিধার্থে রেখা চিত্রের মাধ্যমে তা সহজে ব্যাখ্যা করা হলঃ
শেয়ারের প্রকারভেদ
১. সাধারন শেয়ার (Ordinary / Equity Share):
কোম্পানি আইন অনুযায়ী যে শেয়ার মালিকদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য কোম্পানিতে অধিক থাকে অথচ সাধারণ ভিত্তিতে লভ্যাংশ ভোগ করে এবং মূলধন ফেরত পায় তাকে সাধারণ শেয়ার বলে। এ শেয়ারের মালিকেরা অধিকারযুক্ত শেয়ারের লভ্যাংশ বন্টিত হবার পর শতকরা হারে লভ্যাংশ পায় এবং কোম্পানির বিলুপ্তিকালে সবার শেষে মূলধন ফেরত পায়।
২. অগ্রাধিকার শেয়ার (Preference Share):
যে শেয়ারের মালিকগণ তাদের লভ্যাংশ প্রাপ্তিতে ও মূলধন প্রত্যাবর্তনে অন্যান্য শেয়ার মালিকগণের চেয়েও অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে তাকে অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ার বলে।
অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ারকে নিন্মোক্ত আট শ্রেনীতে বিভক্ত করা যায়ঃ
ক. সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Cumulative Preference Share):
এ ধরনের অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ারের ক্ষেত্রে লাভ হলেই শুধু লভ্যাংশ প্রদান করা হয়। কোন বছর কোম্পানী লাভ না করতে পারলে এবং পরের বছর লাভ হলে এ ধরনের শেয়ার মালিকদের গত বছরের বকেয়াসহ লভ্যাংশ প্রদান করা হয়। এখানে একটি বিষয় লক্ষনীয় যে, সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার মালিকদের বছরভিত্তিক লভ্যাংশ বিলুপ (Lapse) হয় না।
খ. অসঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-cumulative Preference Share):
এ ধরনের শেয়ার মালিকরা শধু লাভ হলেই লভ্যাংশ পাবে। কোন বছর লাভ না হলে তার জন্য কোন বকেয়া (Arear) লভ্যাংশ পাবে না।
গ. পার্টিসিপেটিং শেয়ার (Participating Share):
নির্দিষ্ট লভ্যাংশ ছাড়াও যে শেয়ারের ওপর অতিরিক্ত লভ্যাংশ দেওয়া হয় তাকে পার্টিসিপেটিং বা লভ্যাংশের দাবিযুক্ত বা অংশগ্রহণমূলক অগ্রাধিকার শেয়ার বলে।
ঘ. নন পার্টিসিপেটিং শেয়ার (Non-participating Share):
এ জাতীয় শেয়ারের ওপর শুধুমাত্র নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ প্রদান করা হয়। কিন্তু অন্যান্য শেয়ারের সাথে অতিরিক্ত লভ্যাংশ দেওয়া হয় না।
ঙ. পরিশোধ্য অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ার (Redeemable Preference Share):
যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মূল্য নির্দিষ্ট সময়ান্তে পরিশোধ করে কোম্পানি শেয়ার ফেরত নিতে পারে তাকে পরিশোধ্য অগ্রাধিকারযুক্ত বলে।
চ. অপরিশোধ্য অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ার (Non Redeemable Preference Share):
এ ধরনের শেয়ারের মূল্য কোম্পানীর বিলোপসাধন পর্যন্ত ফেরত দেয়া যায় না। শেয়ার মালিকেরা কোম্পানীর জীবদ্দশায় নির্দিষ্ট হারে মুনাফা ভোগ করতে থাকে।
ছ. পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Convertible Preference Share):
শেয়ার বিক্রয়ের শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ান্তে যে অগ্রাধিকার শেয়ারকে সাধারণ শেয়ারে রুপান্তরের সুযোগ দেয়া হয় তাকে পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার বলে
জ. অপরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Convertible Preference Share):
যে অগ্রাধিকার শেয়ারকে কখনোই সাধারণ শেয়ারে রুপান্তর করা যায় না তাকে অপরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার বলে।
অন্যান্য শেয়ারঃ
উপরিউক্ত কয়েক প্রকারের শেয়ার ছাড়াও আরও কিছু শেয়ার রয়েছে যা নিন্মরূপঃ
ক. বোনাস শেয়ার বা অধিবৃত্তি (Bonus Share):
কোম্পানির শেয়ার মালিকদের মধ্যে নগদে লভ্যাংশ বন্টন না করে লভ্যাংশের বিপক্ষে সাধারণ শেয়ার বণ্টন করা হলে বণ্টনকৃত শেয়ারকে বোনাস শেয়ার বলে। বোনাস শেয়ার কার্যত কোন নতুন ধরনের শেয়ার নয়। শেয়ার মালিকের এরূপ শেয়ার ক্রয়ে কোন নগদ অর্থ দিতে হয় না বিধায় এরূপ শেয়ারকে বোনাস শেয়ার নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
খ. অধিকারযোগ্য শেয়ার বা রাইট শেয়ার (Right Share):
রাইট শেয়ার হচ্ছে এক ধরনের অধিকারমূলক শেয়ার। কোম্পানি গঠনের পরবর্তী সময়ে যদি কোম্পানী তার মূলধন বাড়াতে চায় তবে BSEC এর অনুমতিসাপেক্ষে যে বিশেষ শেয়ার বাজারে ছাড়ে তাকে রাইট শেয়ার বলে। এ শেয়ার সবাই কিনতে পারে না, কোম্পানি গঠনের পরবর্তী সময়ে শেয়ার বিক্রি করার ক্ষেত্রে পুরাতন শেয়ার মালিকগণ ওই শেয়ার ক্রয়ে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন।
যেসব শেয়ারহোল্ডার আগেই ওই কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন তারাই শুধু রাইট শেয়ার কিনতে পারেন। শেয়ারহোল্ডারদের কাছে এই শেয়ার বেশ লাভজনক। কারণ বাজারের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে এই শেয়ারের দাম সাধারণত অনেক কম হয়ে থাকে।
গ. অনাঙ্কিক মূল্যের শেয়ার (Non Per Value Share):
যে শেয়ারের কোনো মূল্য নির্ধারিত থাকে না তাকে অনির্ধারিত বা অনাঙ্কিক মূল্যের শেয়ার বলে। এ শেয়ার সাধারণত বছর শেষে হিসাব নিকাশের পর মোট সম্পদ থেকে অন্যান্য আয়ের পরিমাণ বাদ দিয়ে যে অর্থ পাওয়া যায় তার ওপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারিত হয়।