সিসিএন ডেস্ক : ঢাকার মিরপুরে বসবাসকারী বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ আবু ইউসুফ মাসে প্রায় ২৩ হাজার টাকা আয় করেন। কিন্তু চলমান মূল্যস্ফীতির চাপে তার মাসিক খরচ মেটানোর জন্য এই আয় পর্যাপ্ত নয়।
সম্প্রতি বিয়ের পর ইউসুফ আশা করেছিলেন মাসিক ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা ভাড়ায় এক বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট তিনি পাবেন।
কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় আর সাশ্রয়ী আবাসনের অভাবে এই ভাড়ায় এরকম একটি বাসা তিনি খুঁজে পাননি। শেষ পর্যন্ত ইউটিলিটিসহ প্রতি মাসে ১৪ হাজার টাকায় দুই বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট নিতে হয়েছে তাকে।
এখন ইউসুফ তার এই আর্থিক বোঝা কমানোর জন্য অতিরিক্ত ঘরটি সাবলেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
'দুই রুমের ফ্ল্যাটের পুরো ভাড়া আমি কী করে বহন করব?' বলছিলেন ইউসুফ।
তিনি আরও বলেন, ঘরটি সাবলেট দিতে গিয়ে আর্থিক বোঝা হয়তো কমেছে কিন্তু সাবলেটের কারণে পারিবারিক স্বস্তির যে বিষয় তার মূল্য দিতে হয়েছে।
ঢাকার আশুলিয়ায় সাবলেটে থাকেন আহসান হাবিব সবুজ। তিনি বলেন, চরম আর্থিক দুরাবস্থায় না পড়লে কেউ তার ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করতে চায় না।
তিনি ডিসেম্বর মাসে ৮ হাজার ২০০ টাকা বাড়ি ভাড়ার মধ্যে ৪ হাজার ৭০০ টাকা পরিশোধ করেছেন।
এখানকারই একজন পোশাক শ্রমিক (৩৫) জানান, এই এলাকায় হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক বসবাস করেন, যারা খরচ কমাতে বাসা ভাগাভাগি করে থাকেন। তার বাসাতেও তিনি ও তার স্ত্রীর সঙ্গে আরেক পোশাককর্মী সাবলেট থাকেন বলে জানান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে দুই লাখেরও বেশি মানুষ সাবলেট ছিলেন।
সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা পরিচালিত ডেমোগ্রাফিক ডেটা সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে এই পরিবারগুলোর মধ্যে ৭০ হাজার পরিবার প্রথমবারের মতো সাবলেট গ্রহণ করেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় মানুষ ব্যয় কমাতে বাধ্য হওয়ায় ঢাকার ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ মানুষ সাবলেট থাকেন। যা ২০২১ সাল থেকে ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি। গত মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে।
শহর এলাকার সীমিত ও মধ্যম আয় যাদের তারাই মূলত সাবলেট নিয়ে থাকেন।
একই সময়ে রাজধানী শহরে সাবলেট দেওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ০ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়ে এর জনসংখ্যার ২ দশমিক ০৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালের জনসংখ্যা ও গৃহায়ন আদমশুমারি অনুসারে, ঢাকার জনসংখ্যা ২৭ লাখ পরিবারে এক কোটি দুই লাখ।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'ঢাকা শহরের দ্রুত নগরায়ন এবং দারিদ্র্য পরিস্থিতির সঙ্গে সাবলেটে বৃদ্ধির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।'
'কারণ মানুষ মনে করে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে খরচ কমাতে তাদের ঘর ভাগ করে নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।'
এছাড়াও দ্রুত নগরায়ণের মধ্যে আবাসন শিল্পের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়েছে বলে যোগ করেন তিনি।
গৃহস্থালী আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশে নগর দারিদ্র্যের হার বর্তমানে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ঢাকা বিভাগে এটি ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জিল্লুর রহমান বলেন, সুস্পষ্ট ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সাবলেট আবাসন সংকটের নতুন সমাধান হয়ে উঠছে।
উদাহরণস্বরূপ, শহরাঞ্চলে অনেক ছাত্র ও শ্রমিক হোস্টেলে বা ভাগ করে থাকা যায় এমন ব্যবস্থার মধ্যে থাকতেন।
এখন, অনেক পরিবার এই ছাত্র ও শ্রমিকদের জন্য তাদের ঘর সাবলেট দিচ্ছে কারণ এটি তাদের যেমন খরচ কমায় তেমনি যারা সাবলেট থাকে তাদেরও জীবনযাপনের জন্য ভালো একটা পরিবেশ দেয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের উচ্চমূল্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষকে ভাড়ার খরচ কমাতে বাধ্য করেছে।
'এজন্য কেউ কেউ সাবলেট নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ পরিবারের সবাইকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন খরচ সামলাতে।'
তিনি বলেন , ঢাকার বাইরের অঞ্চলগুলো পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে কারণ দেশের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়নি। আর এ কারণে রাজধানী শহরে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের চাহিদা বাড়ছে।'
এই প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, শহরে নিম্ন আয়ের মানুষের চাহিদা মেটাতে সামাজিক বা অংশীদারি আবাসন একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে।
'সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের সরবরাহ বাড়াতে উপযুক্ত নীতি, কৌশল এবং উদ্যোগ প্রয়োজন।'
সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন চাহিদা বসবাসের জায়গা কমাচ্ছে
সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে, নির্মাণ কোম্পানিগুলো ছোট ছোট ইউনিট তৈরি করতে শুরু করেছে যেগুলোর ভাড়া কম। ২০২২ সালে শয়নকক্ষের গড় আকার বছরে ০ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে এবং ২০২০ সালের তুলনায় ২৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
থাকার জায়গা কমে যাওয়ায় পরিবারের সুযোগ-সুবিধার ভাগাভাগি বেড়ে যায়। দেশের সমস্ত পরিবারের ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ একক বাথরুম ব্যবহার করে।
এসব পরিবারের প্রায় ৩১ দশমিক ২ শতাংশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ছড়িয়ে আছে, যাদের বাথরুম শেয়ার করার প্রাথমিক কারণ সাবলেটিং।
ঢাকার পরে রাজশাহীতে পরিবার প্রতি শেয়ার্ড বাথরুম সবচেয়ে বেশি। মোট সংখ্যার ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ।
বাথরুম ভাগ করে নেওয়ার দিক দিয়ে সবচেয়ে কম সংখ্যক পরিবার বরিশালে। সেখানে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ শেয়ার্ড বাথরুম ব্যবহার করে।