২০২২ সালের আইকিউএয়ার সূচকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ছিল পঞ্চম। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণ মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার অন্যতম প্রধান কারণ। নিম্নমানের ও দূষিত বাতাসের সংস্পর্শ অল্প সময়ের জন্য হলেও তা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। নিশ্বাসের সঙ্গে দূষিত বাতাস গ্রহণের কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমানো, ক্যানসার, হৃদ্যন্ত্রের অসুখসহ স্বাস্থ্যগত নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে।
কণাসদৃশ বস্তুর উপস্থিতিকে ঢাকার বায়ুদূষণের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কণা এত ছোট যে এমন কয়েক কোটি কণা একটিমাত্র লাল রক্তকণিকায় জায়গা নিয়ে নিতে সক্ষম, যা শ্বসনতন্ত্র বা হৃদ্যন্ত্রের রোগ বা অন্য কোনো রোগের মাধ্যমে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। ওজোন, দূষণ সৃষ্টিকারী কণা ও ধুলার কারণে কম বয়সীদের মধ্যে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে ৬০ থেকে ৯৫ বা এর বেশি বয়সীদের মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজের (জিবিডি) মতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত রোগে মৃত্যুর হার ২০১৯ সালে আগের ২০ বছরের তুলনায় ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের (একিউএলআই) মতে, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার বাসিন্দারা গড়ে আট বছরের আয়ু হারাচ্ছেন।
শহরাঞ্চলের বাতাস পরিচ্ছন্ন রাখাসহ সার্বিকভাবে বায়ুদূষণের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে হলে বাস্তবায়নযোগ্য ও কার্যকর নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে সম্ভাব্য কিছু সমাধান হতে পারে, আমদানি খরচ কমিয়ে হাইব্রিড প্রযুক্তির গাড়ির ব্যবহারকে উৎসাহিত করা, নিয়মিতভাবে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা, কার্বন নিঃসরণ কমাতে কার্বন ট্যাক্স আরোপ করা এবং নির্মাণকাজের সময় ব্যবহৃত সামগ্রী রাখা ও পরিবহনের বিষয়টি সঠিক নিয়মের আওতায় আনা।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির বার্ষিক গড় খরচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, ২০২০ সালে যা ৭৪ শতাংশে পৌঁছেছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ব্যয় বড় এক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূষণের কারণে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির আর্থিক চাপ তো বাড়ছেই, এর পাশাপাশি আবার দূষণের কারণে রোগব্যাধির জন্য কর্মক্ষেত্রে মানুষের উৎপাদনশীলতা কমছে, যা আবার নতুন করে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলোতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রধান উৎস বা কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে গাড়ির ব্যবহার, কয়লানির্ভর শক্তিকেন্দ্র, ইটভাটা, শিল্পকারখানা, সড়কের ধুলা এবং ভবন নির্মাণ। বাংলাদেশে গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি থেকে নির্গত কার্বনের পরিমাণও বেড়েছে। মূলত গাড়ির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, ভেজাল জ্বালানির ব্যবহার, ট্রাফিক–ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং পার্কিংয়ের জন্য যথেষ্ট জায়গা না থাকার মতো কারণে এমনটি ঘটছে।
ইটভাটা এ দূষণের আরেকটি বড় কারণ। ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৮ সালে সারা দেশে ৮ হাজার ইটভাটা সচল ছিল, যেখানে বছরে ১ হাজার ৫০০ কোটি ইট তৈরি হতো। বাংলাদেশে এখনো পুরোনো পদ্ধতিতে ইট তৈরি করা হয়, যা পরিবেশকে দারুণভাবে দূষিত করছে।
নির্মাণকাজ চলাকালে নির্মাণসামগ্রী রাখা বা পরিবহনের সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিমালা না থাকায় নির্মাণস্থলগুলোতে প্রচুর ধুলা থাকে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে ঢাকায় প্রতিদিন ৫০০ মেট্রিক টন ধুলা সড়কে পড়ে এবং ২ হাজার মেট্রিক টন ধুলা বাতাসে ওড়ে। এ ছাড়া আন্তসীমান্ত বায়ুদূষণের প্রভাবও বাংলাদেশের বাতাসে দূষণ বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের দূষণের ৪০ শতাংশই ঘটে ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর কারণে। জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের দূষণ মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের শহরগুলোতে বায়ুদূষণের অবস্থা প্রতিমুহূর্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবুজ পরিবেশ ও পরিচ্ছন্ন বাতাসকে জাতীয় অগ্রাধিকার ঘোষণা করা দরকার। বায়ুদূষণ মোকাবিলায় বাতাসের গুণগত মানের সঙ্গে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশগত বিষয়গুলোর সম্পর্কের বিষয়টি কার্যকর সরকারি নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বাতাসের মান বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কার্যকর নজরদারি ও সুশাসনের অভাবে এসবের বাস্তবায়ন পুরোপুরি সফল হয়নি।
শহরাঞ্চলের বাতাস পরিচ্ছন্ন রাখাসহ সার্বিকভাবে বায়ুদূষণের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে হলে বাস্তবায়নযোগ্য ও কার্যকর নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে সম্ভাব্য কিছু সমাধান হতে পারে, আমদানি খরচ কমিয়ে হাইব্রিড প্রযুক্তির গাড়ির ব্যবহারকে উৎসাহিত করা, নিয়মিতভাবে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা, কার্বন নিঃসরণ কমাতে কার্বন ট্যাক্স আরোপ করা এবং নির্মাণকাজের সময় ব্যবহৃত সামগ্রী রাখা ও পরিবহনের বিষয়টি সঠিক নিয়মের আওতায় আনা।
এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় বাস্তবায়নে সরকারের কঠোর হওয়া দরকার। যেমন অবৈধভাবে চালু থাকা ইটভাটাগুলো বন্ধ করা এবং ২০ বছরের বেশি পুরোনো বাস ও ২৫ বছরের বেশি পুরোনো ট্রাক নিষিদ্ধ করা। সবশেষে কয়লানির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির পেছনে বিনিয়োগ করলে বায়ুদূষণ কমবে, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি প্রশমিত হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। রাজনীতিবিদ, গবেষক, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের মধ্যে এ ব্যাপারে জোর অঙ্গীকার নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ প্রশমনের জন্য কার্যকর একটি রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব হবে।