শেয়ার বাজার

নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করা সময়ের দাবী

নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করা সময়ের দাবী
জাতীয়

সুশাসন, পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রান্তিক পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যাপ্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন ঢাকা শহরের বিকেন্দ্রীকরণ এবং বাংলাদেশের টেকসই নগারয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত “ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এবং বাংলাদেশের টেকসই নগরায়ন” শীর্ষক সেমিনারে অংশগ্রহণকারী আলোচকবৃন্দ। উল্লেখ্য অদ্য ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত উল্লেখিত সেমিনারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, এমপি উক্ত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ।  

অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মোঃ সামীর সাত্তার বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে নগরায়ন এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে আমাদের জিডিপির ৬৫% আসছে শহরাঞ্চল হতে। তিনি বলেন, ঢাকা কেন্দ্রিক নগরায়নের জন্য আমরা যেভাবে যানজট, পানি দূষণ, বায়ু দূষণ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি, সেই সাথে আমাদের কর্মঘন্টা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে জ¦ালানী খরচ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি, এমতাবস্থায় ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি ঢাকার নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করা সময়ের দাবী বলে মত প্রকাশ করেন ডিসিসিআই সভাপতি। দেশের প্রতিটি শহরে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় আইনগত, প্রশাসনিক, অবকাঠামো ও আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো, পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহরের বিকাশ, ঢাকার বাইরে বসবাসকারীদের জন্য ট্যাক্স হলিডে, সুলভ মূল্যে ইউটিলিটি পরিসেবা প্রদানের পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের আহŸান জানান ব্যারিস্টার সামির সাত্তার। তাছাড়াও টেকসই নগরায়ন ও শহরের বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিতকরনে সুশাসন, পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই বলে মত প্রকাশ করেন, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি।        

সেমিনারের প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, এমপি বলেন, আমাদের সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিক, এটাই বাস্তবতা, তবে এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, সরকার ঢাকার বাইরেও অবকাঠমোখাতে উন্নয়ন করেছে এবং আশা প্রকাশ করেন এর সুফল দেশবাসী সহসাই পাবেন। তিনি জানান, মেট্রোরেলের অবকাঠামোর সম্প্রসারণ আরো ১০-১৫ বছর চলমান থাকবে, ফলে যানজট কমবে এবং নগরবাসী উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা উপভোগ করবেন। রাজধানীর ঢাকার উপশহরগুলোকে আরো উপযোগী করার জন্য সরকার নিরসলভাবে কাজ করছে বলে তিনি অভহিত করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অবকাঠামোখাতে উন্নয়ন ও শিল্পায়নে জোরারোপ করার কারণে আমাদের অর্থনীতিতে গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তিনি জানান, ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাস ও সরকারী কার্যক্রম স্বচ্ছতা এবং সুশাসন নিশ্চিতকল্পে সরকার কাজ করছে। মন্ত্রী বলেন, সিটি জরিপে কিছু ভুল পরিলক্ষিত হয়েছে, তবে ডিজিটাল সার্ভে গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে, যা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হলে দেশবাসী আধুনিক সেবা সুবিধা পাবেন। তিনি বলেন, তিন ফসলি জমিতে কোন শিল্প-কারাখানা নয়, কারণ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, সেই সাথে দুফসলি জমিতেও শিল্প কারখানা স্থাপন না করার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি আহŸান জানান। কৃষি ভিত্তিক শিল্প-কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর তিনি জোরারোপ করেন।               

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ড্যাপের পুরোপুরি সংশোধন না করে, ব্যবসায়ীদের যেন হয়রানি না করা হয়, সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তিনি বলেন, ফ্ল্যাট ও জমি রেজিস্ট্রেশনে করারোপের কারণে জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রি বেশ কমে গেছে, তবে বিষয়টি নিয়ে এনবিআর কাজ করছে, আশাকরি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন গ্রাম উন্নয়নে শুধুমাত্র প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, জীবনযাপনে সকল প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিস্তার করতে হবে, যেন গ্রামের মানুষ আর্থিকভাবে সক্ষম হয়। ইকোনোমিক জোনের আশেপাশের জায়গায় শ্রমিকদের বাসস্থান তৈরিতে সরকার কাজ করছে বলে তিনি অভহিত করেন। সচিব আরো বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরতে কমপক্ষে ২৫শতাংশ কৃষি জমি সুরক্ষা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই।        

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর নগর আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য দেশের জলবায়ু, নদী মরাতœকভাবে দূষণ করছে, যার প্রতি আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে তিনি অবকাঠমো উন্নয়নে মান নিশ্চিত করতে হবে, যেন এর মাধ্যমে পবিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। ব্যবসা-বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনায় আরো কমপ্লায়েন্স মেনে চলা হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের আহŸান জানান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব।        

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহ-সভাপতি এবং ভিত্তি স্থপতি বৃন্দ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৩শতাংশ লোক নগরে বাস করেন এবং ঢাকা মহানগরীতে প্রতিবছর নতুন করে ৫ লাখ লোক যোগ হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত গৃহহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বর্জ্য বৃদ্ধি, পানি ও বায়ু দূষণ, বৃক্ষ নিধন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা, যানজট ও স্বাস্থ্য সংকটের শিকার হচ্ছি। তিনি জানান, রাজধানীতে বিদ্যমান সবুজের পরিমাণ মাত্র ৮ শতাংশ, যা প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে, সবুজ সুরক্ষা আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। তিনি ঢাকার বিকেন্দ্রীকরনের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত নগরায়ন, শহরের বিকেন্দ্রেীকরণ ও গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আরো জোরারোপের আহŸান জানান। এছাড়াও স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই স্মার্ট সিটি তৈরিতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানান। সেই সাথে বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিতকল্পে কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থাপর পরিবর্তে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদান ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা তৈরি এবং অবকাঠামো নির্মাণ সহ আনুষাঙ্গিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা আবশ্যক বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।     

নির্ধারিত আলোচনায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থপতি অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি-এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন এবং নতুনধারা এ্যাসেট্ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. শহীদ-উজ্জ-জামান অংশগ্রহণ করেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থপতি অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির বলেন, ঢাকায় মানুষের আসার প্রবণতা হ্রাসে রাজধানীর বাইরে জনগনের জীবনযাত্রা পরিচালনায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমরা অতিদ্রæত কৃষি জমি হারিয়ে ফেলছি, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এবং খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিজমি সুরক্ষায় আমাদের আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি-এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঢাকা শহরের জন্য একটা ভিশন প্রয়োজন এবং এ জন্য সুশাসনের পাশাপাশি জনগনের সম্পৃক্ততা একান্ত অপরিহার্য। তিনি বলেন, রাজউকের পুনঃগঠন করা এখন সময়ের দাবী। এছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিটি শহরের মাষ্টারপ্ল্যান থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। রিজওয়ানা হাসান আরো বলেন, আবাসন হলো মানুষের মৌলিক অধিকার, সেটাকে নিশ্চিত করতে সরকারকে আরো মনোযোগী হতে হবে। সেই সাথে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে জমির সর্বোত্তম নিশ্চিত করা এবং শিল্প-কারখানার বর্জ্য যেন নদীগুলোকে নষ্ট না করে, সেদিকে মনোযোগী হওয়ার উপর তিনি জোরারোপ করেন। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকা শহরের নগরায়নে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়, তাই এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তয়নের ক্ষেত্রে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে। এছাড়াও তিনি দেশের নগর পরিকল্পনাবিদের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে আরো সম্পৃক্ত করার উপর জোরারোপ করেন। ডা. মো. শহীদ-উজ্জ-জামান ঢাকা শহরের সাথে আশেপাশের এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ঢাকা শহরের বিকেন্দ্রেীকরণ ও স্মার্ট শহর তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের সাথে বেসরকারিখাতকেও একযোগে কাজ করার প্রস্তাব করেন। 

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে এখাতের প্রতিনিধিবৃন্দ যানজট নিরসনে বহুতল বিশিষ্ট পার্কিং সুবিধা বৃদ্ধি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সংখ্যা বাড়ানো, বুড়িগঙ্গা নদীর নাব্যতা ও ব্যবহার উপযোগীতা বৃদ্ধি, পুরোনো ঢাকা হতে কেরানীগঞ্জে শিল্প-কারখানা স্থানান্তরে অবকাঠমো উন্নয়ন ও প্রণোদনা সহায়তা প্রদানের সুপারিশ করা হয়।