শেয়ার বাজার

ছাত্রদের শি ক্ষার মান নির্নয়ে ত্রিভুজ চতুর্ভুজ পদ্ধতি

ছাত্রদের শি ক্ষার মান নির্নয়ে ত্রিভুজ  চতুর্ভুজ পদ্ধতি
শিক্ষা

সিসিএন ডেস্ক : নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যতম লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমানো। নম্বর বা জিপিএ-৫ পাওয়ার কথিত যুদ্ধও থামানো। বলা যাবে না ‘কেউ ভালো, কেউ খারাপ’। তারা কাজ করতে করতে শিখবে-জানবে। মোট কথা হাতে-কলমে শেখানো এ শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য। অথচ বছর শেষে উল্টো চিত্র দেখছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়নের নামে ত্রিভুজ পাওয়ার অঘোষিত লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

জানা যায়, চলতি বছর মাধ্যমিক পর্যায়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ালেখা করছে শিক্ষার্থীরা। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তাদের ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন হয়। বছরের শেষে এখন হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কেমন এবং কীভাবে করতে হবে, তার টুলস (নির্দেশিকা) গত ৫ নভেম্বর স্কুলে পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এটি প্রণয়ন করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমে পারদর্শিতার সূচক (পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) অনুযায়ী ফল প্রকাশ করা হবে। সূচক ধরে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ চিহ্ন দেবেন শিক্ষকরা। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি করে বিষয়। সেগুলো হলো—বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্মশিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। সবগুলো বিষয়েই চিহ্ন দিয়ে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা।

নির্দেশিকার ‘শ্রেণি উন্নয়ন নীতিমালা’ অংশের তথ্যানুযায়ী— একজন শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে দুটি বিষয় বিবেচনা করা হবে। প্রথমত শিক্ষার্থীর স্কুলে উপস্থিতির হার এবং দ্বিতীয়ত বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতা। ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকলে তাকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে ধরা হবে এবং পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা যাবে।

দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় হলো পারদর্শিতার নির্দেশকের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা। সর্বোচ্চ তিনটি বিষয়ের ট্রান্সক্রিপ্টে সবগুলো পারদর্শিতার নির্দেশকে কোনো শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা যদি ‘চতুর্ভুজ’ স্তরে থাকে, তবে তাকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তরণের জন্য বিবেচনা করা যাবে না।

মূল্যায়ন নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, পারদর্শিতার বিবেচনায় কোনো শিক্ষার্থী যদি পরবর্তী শ্রেণিতে ওঠার জন্য বিবেচিত না হয়, তখন শুধু উপস্থিতির হারের ভিত্তিতে তাকে উত্তীর্ণ করানো যাবে না। তবে পারদর্শিতার বিবেচনায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ক্লাসে উপস্থিতি কম হলে পরের ক্লাসে তাকে উঠতে দেওয়া হবে কি না, তা শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নেবেন।

কেউ একই ক্লাসে থেকে গেলে তাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আত্মউন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। এতে তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয় শিক্ষক সহযোগিতা করবেন। আর এক বা একাধিক বিষয়ে শিখন ঘাটতি নিয়ে পরের ক্লাসে উঠে যাওয়া শিক্ষার্থীকে ছয় মাসের শিখন উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। অন্যদিকে পরের ক্লাসে উঠতে না পারা শিক্ষার্থীরাও বছর শেষে তার পারদর্শিতার ভিত্তিতে ট্রান্সক্রিপ্ট পাবে।

কী করলে ত্রিভুজ, কী করলে চতুর্ভুজ

শিক্ষার্থী কী করলে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজের মধ্যে একটি ইনডিকেটর পাবে, তা জানতে স্কুলে পাঠানো টুলস বা নির্দেশিকা পর্যালোচনা করা হয়। অধ্যায় অনুযায়ী কাজ ও শেখার ধরন ভিন্ন। যেমন—ষষ্ঠ শ্রেণির জীবন ও জীবিকা বিষয়ের ৭ নম্বর অধ্যায়ে রয়েছে স্কিল কোর্স। এ অধ্যায়ে পারদর্শিতার সূচক ৬.৭.১-সঠিকভাবে ভাত রান্না করতে পারা এবং বাড়িতে নিয়মিত ভাত রান্নার অনুশীলন। এ সূচক অনুযায়ী পারদর্শিতার মাত্রায় বলা হয়েছে, যদি কোনো শিক্ষার্থী ‘ভাত রান্নায় আংশিক দক্ষতা অর্জন করে এবং কদাচিৎ বাড়িতে ভাত রান্নার অনুশীলন করে’ তখন তাকে চতুর্ভুজ দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে।

কেউ যদি ‘পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে, নিরাপত্তা মেনে ভাত রান্না করতে পারে এবং বাড়িতে মাঝে মধ্যে অনুশীলন করে’ তাহলে তাকে বৃত্ত চিহ্ন দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। আবার কেউ যদি ‘পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে, নিরাপত্তা মেনে ভাত রান্না করতে পারে এবং বাড়িতে নিয়মিত অনুশীলন করে’ তখন সে পাবে ত্রিভুজ, যা পারদর্শিতার সূচকের মাত্রায় ‘দক্ষ’ বলে বিবেচিত।

সপ্তম শ্রেণির গণিত বিষয়ের ৮ নম্বর অভিজ্ঞতার শিরোনাম ‘চলো বৃত্ত চিনি’। এ অধ্যায়ের পারদর্শিতার সূচক ৭.৩ ও ৭.৮। পারদর্শিতার সূচক ৭.৩.১ হলো ক্ষেত্র অনুযায়ী ‘উপযুক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিমাপের ফল নির্ণয়’। এ সূচকে পারদর্শিতার মাত্রার ঘরে বলা হয়েছে, ‘যে কোনো একটি পরিমাপ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফল নির্ণয় করতে পেরেছে’ এমন শিক্ষার্থী চতুর্ভুজ পাবে।

আবার ‘একাধিক পরিমাপ পদ্ধতি ব্যবহার করে ফল নির্ণয় করতে পেরেছে’ এমন শিক্ষার্থীরা বৃত্ত চিহ্নে মূল্যায়িত হবে। আর ‘বাস্তব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যথাযথ পরিমাপ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে ফল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে পারা’ শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে ‘দক্ষ’ বিবেচিত হবে এবং তাদের ত্রিভুজ চিহ্নে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা।

যা বলছেন অভিভাবকরা

নির্দেশিকা প্রকাশের পর উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে অভিভাবকদের। তিন বিষয়ে চতুর্ভুজ পেলে সন্তান পরের ক্লাসে উঠতে পারবে না, এটা নিয়েই এখন তাদের বেশি উদ্বেগ। অভিভাবকদের অভিযোগ, পাস-ফেল নেই বলে এনসিটিবি, মাউশি ও স্কুলের পক্ষ থেকে এতদিন যা বলা হয়েছে, তা তো এখন পুরোপুরি মিথ্যা। এখানে ত্রিভুজকে সবচেয়ে দক্ষ বা ভালো, বৃত্তকে মোটামুটি ভালো এবং চতুর্ভুজকে খারাপ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সামষ্টিক মূল্যায়নের মাত্র চারদিন আগে এগুলো জানানো হচ্ছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির একজন ছাত্রীর মা বলেন, সন্তান কী করছে, তা শুধু শিক্ষকরাই জানছেন। লিখিত পরীক্ষা বলে কিছু তো নেই। এখন দলগত ও একক কাজ ভালো করলেও কোনো শিক্ষক যদি কাউকে চতুর্ভুজ দিয়েও দেন, তা চ্যালেঞ্জ করার বা অভিযোগ করার কোনো সুযোগ থাকছে না। বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা সবাই এখন ত্রিভুজ পাওয়ার জন্য শিক্ষকের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘আগে শিক্ষকের কাছে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানসহ দু-তিনটা সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়াতে দিলেই হতো। এখন ১০ সাবজেক্টে তো ১০ জন শিক্ষকের কাছে পড়াতে পাঠাতে হবে। তা না হলে দেখা যাবে, আমার সন্তানকে চতুর্ভুজ দিয়ে দিচ্ছে।’

বোরহান উদ্দিন সোহেল নামে আরেক অভিভাবক বলেন, নতুন কারিকুলামে তো পড়ালেখা নেই। সবাই বলছে ইন্টারনেট ও বই দেখে লেখা যায় এখন। এরপরও যদি কোনো শিক্ষার্থীকে শিক্ষকরা চতুর্ভুজ দিয়ে দেন, তাহলে তো সবাই বলবে বই দেখে, ইন্টারনেট দেখে লিখেও পাস করতে পারেনি। তখন ওই শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা কেমন হবে? এটা কী চাপ নয়?

সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘চাপ থাকুক, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করুক। তাতে আমাদের তো আপত্তি নেই। কিন্তু কারিকুলামে যেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, যেভাবে দলগত প্রজেক্টের কাজ দেওয়া হচ্ছে; তাতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন।’

তিনি বলেন, ‘সারাবছর শিক্ষার্থীরা কিছুই করলো না। বছর শেষে তাদের মূল্যায়ন হবে। শহরের শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ ইন্টারনেট দেখে কিছু কাজ করলেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা কিছুই শেখেনি। তারা পড়েওনি, কাজও করেনি। এভাবে চলতে থাকলে গ্রামের মেধাবী অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। অকালেই তাদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাবে।’

রাজধানীর মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে  বলেন, ‘প্রত্যেকটি বিষয় মূল্যায়নের জন্য যত বড় গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে, তা ৩-৪ দিনে আয়ত্ত করা শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ ৯ নভেম্বর থেকে সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হবে। এখন শিক্ষকরা না বুঝে যদি ভুল করে বসেন, তখন এর দায় কে নেবে?’

তিনি বলেন, ‘ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আলাদা শিক্ষক। কেউ গণিতের সূচক ঠিক করবে, কেউ বাংলার। যদি কেউ তিন বিষয়ে চতুর্ভুজ পেয়ে যায় সে তো পরের ক্লাসে উঠতে পারবে না। অথচ পরীক্ষা পদ্ধতিতে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে ফেলের হার নেই বললেই চলে। এটা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ, শিক্ষকদের ওপরও বাড়তি চাপ।’

জানতে চাইলে এনসিটিবির শিক্ষাক্রম ইউনিটের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘যে টুলস শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে, তাতে খুব স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। একজন শিক্ষার্থীকে চাইলেই চতুর্ভুজ দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েকটি সূচকের মাত্রা মিলিয়ে সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। আমার তো মনে হয় কেউ এত বেশি চতুর্ভুজ পাবে না। এগুলো নিয়ে অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের চিন্তা না করাই ভালো।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের রেকর্ড সংগ্রহের জন্য ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজের মতো চিহ্নগুলো ব্যবহার করা হলেও ট্রান্সক্রিপ্টে এগুলোর কোনো উল্লেখ থাকবে না। এটা নির্দেশিকায় উল্লেখ রয়েছে। সেখানে আমরা বলেছি, ট্রান্সক্রিপ্টের ফরম্যাটে উল্লেখিত চিহ্নগুলোর পরিবর্তে শিক্ষার্থীর অর্জিত সর্বোচ্চ পারদর্শিতার মাত্রা টিক চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হবে।’