আল্পস পর্বতের নীচে ছবির মত সুন্দর ম্যাগিওর হ্রদে হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে মানুষ ভর্তি একটি নৌকা ডোবার ঘটনা নিয়ে বিস্তর চর্চা শুরু হয়েছে বিশেষ করে ইটালি ও ইসরায়েলে।
বিশেষ করে পানিতে ডুবে নিহত চারজনের নাম-পরিচয় প্রকাশ এবং যাত্রীদের পেশাগত পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার এই দুর্ঘটনা বিস্ময় এবং সন্দেহের উদ্রেক করেছে।
নিহতদের দুজন ছিলেন ইটালির গোয়েন্দা কর্মকর্তা, একজন ছিলেন ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সাবেক এজেন্ট, এবং অন্যজন এক রুশ নারী।
দুর্ঘটনার জায়গাটিও বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছ। আল্পস পর্বতের নীচে এই হ্রদের একদিকে ইটালির লোমবার্ডি অঞ্চল, অন্য তীরে সুইজারল্যান্ডের টিচিনো। লোমবার্ডিতে বেশ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে যেখানে সামরিক প্রযুক্তি তৈরি হয়। তাছাড়া, এমনিতেই মনে করা হয় যে সুইজারল্যান্ড নানা দেশের গোয়েন্দা এবং গুপ্তচরদের যাতায়াতের একটি ট্রানজিট পয়েন্ট, এই দেশটি হয়েই বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দারা অন্যান্য দেশে যাতায়াত করে।
ছোটো আকারের এই প্রমোদ নৌকাটিতে মোট ২৩ জন ছিলেন। জানা গেছে তাদের অনেকেরই এই হ্রদের আশপাশে অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ি রয়েছে।
ইটালির দৈনিক ইল কোরিয়ের দেল্লা সেরায় খবর বেরিয়েছে এই এলাকায় ইটালি এবং ইসরায়েলি সরকারি লোকজনের নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরার অধিকার রয়েছে।
লেকের ওপর গুপ্তচরদের গোপন বৈঠক?
কিছু কিছু রিপোর্টে বলা হচ্ছে নেহাত বিনোদনের জন্যই নৌকাটিতে করে বের হয়েছিলেন এর যাত্রীরা।
তবে ইটালির কিছু সংবাদপত্র খবর দিয়েছে, ডোবার আগে নৌকাটিতে ইটালি এবং ইসরায়েলি গুপ্তচরদের মধ্যে একটি বৈঠক চলছিল।
নৌকাডুবির এই ঘটনা ইটালিতে এতটাই আলোচনার জন্ম দিয়েছে যে সরকার ২৮শে মে নৌকাটি কিভাবে ডুবেছিল তা তদন্তে কার্লোস নোসেরিনা নামে তাদের একজন প্রসিকিউটার বা কৌসুলিকে নিয়োগ করেছে।
তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে নৌকাটিতে ২১জন গুপ্তচর ছিলেন যাদের ১৩ জন ইটালির আর আটজন ইসরায়েলের।
শুধু নৌকার চালক ক্লডিও কারমিনাটি এবং তার নিহত স্ত্রী – যিনি একজন রুশ নাগরিক- কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যুক্ত নন।
কিছু রিপোর্ট বলছে ১৫ মিটার লম্বা এই প্রমোদ নৌকাটি ভাড়া করা হয়েছিল একজনের জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্যে।
কিন্তু নৌকাটি হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝড়ের মধ্যে পড়ে যায় এবং ঘণ্টায় ৭০ কিমি বেগের বাতাস সেটি সহ্য করতে পারেনি।
“৩০ সেকেন্ডের মধ্যে যেন এক অলৌকিক প্রলয় নেমে আসে আমাদের ওপর,” দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইটালিয়ান দৈনিক ইল কোরিয়ের ডেলা সেরাকে বলেন ক্যাপ্টেন মি. কারমিনাটি। “নৌকাটি সাথে সাথে ডুবে যায়, এবং আমরা দেখলাম সবাই পানিতে।“
মি. কারমিনাটি তদন্তকারীদের বলেন এমন খারাপ আবহাওয়ার কোনে পূর্বাভাস ছিলনা। তবে ঘাটে ফিরে আসার নির্ধারিত সময়রে পরও নৌকাটি হ্রদের ভেতর ছিল।
তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ‘অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের’ তদন্ত শুরু হয়েছে। তার কারণেই নৌকাটি ডুবেছে কিনা তাও তদন্ত করা হচ্ছে।
ক্যাপ্টেন কারমিনাটির নিহত স্ত্রী ৫০ বছর বয়স্কা আনা কোজকোভা রুশ নাগরিক, তবে ইটালিতে তার বসবাসের অনুমতি ছিল।
নিহতদের অন্যরা ছিলেন: তিজিনা বারনবি, ৫৩, ক্লডিও আলোনজি, ৬২ – দুজনেই ইটালিয়ান গুপ্তচর সংস্থার এজেন্ট। ৫০ বছর বয়স্ক ইসরায়েলি সিমোনি এরেজও নৌকাডুবিতে মারা গেছেন। তিনি ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তার নাম ইটালির মিডিয়াতে প্রকাশ করা হলেও ইসরায়েলি মিডিয়া তার নাম করেনি।
অন্যদের অনেকে সাঁতরে তীরে উঠতে সমর্থ হয়। আশপাশের কিছু নৌকা গিয়ে বাকিদের টেনে তোলে।
উদ্ধারকাজে অংশ নেয় ইটালির পুলিশ এবং দমকল বাহিনী। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৃত্যুগুলো হয়েছে নৌকা ডুবেই, এবং ইটালিয়ান মিডিয়া খবর দিয়েছে কোনো ময়না তদন্ত করা হয়নি।
বেঁচে যাওয়া লোকজন উধাও
দুর্ঘটনাটি অন্য যে রহস্যের জন্ম দিয়েছে তা হলো যারা বেঁচে গেছেন তারা যত দ্রুত সম্ভব জায়গা ছেড়ে চলে যান।
ইটালিয়ান মিডিয়ার খবর অনুযায়ী উদ্ধার হওয়ার পরপরই তারা তাদের হোটেল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে দ্রুত চলে যান। যাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই তারা সরে পড়েন। কাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল তার কোনো রেকর্ডও মেলেনি।
ইসরায়েলিরা তাদের ভাড়া করা গাড়ি ফেলে চলে যান। জানা গেছে সোমবার মিলান থেকে একটি ইসরায়েলি বিমান তাদের তুলে নিয়ে যায়।
বেঁচে যাওয়ার যাত্রীদের নাম-ধাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু সরকারি কৌসুলি এবং তদন্তকারী মি. নোসেরিনো বিবিসিকে বলেন নিহতদের নাম প্রকাশ স্বাভাবিক হলেও দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষজনের নাম-পরিচয় জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহুর অফিস থেকে বুধবার নিশ্চিত করা হয়েছে ইসরায়েলি যে নাগরিক মারা গেছেন তিনি মোসাদের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা ছিলেন।
“মোসাদ একজন একজন নিবেদিতপ্রাণ পেশাদার বন্ধু হারিয়েছে যিনি গত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন,“ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে জারী করা এক বিবৃতিতে বলা হয়।
“মোসাদে তার যে দায়িত্ব ছিল তাতে তার নাম-পরিচয়ের বিস্তারিত প্রকাশ করা সম্ভব নয়।“
নৌকায় অতিরিক্ত মানুষ ছিল?
ডুবে যাওয়া নৌকাটি এখনও তীরে আনা হয়নি। ফলে, বিবিসিকে বলেন মি. নোসিরিনো, তদন্ত ঠিকমত শুরু করা যায়নি।
“এ মূহুর্তে নৌকাটি হ্রদের তলে মাটিতে ঠেকে রয়েছে। টেনে তুলতে দু-তিনদিন লেগে যেতে পারে।“
মি নোসিরিনো আরও বলেন, নৌকাটির ধারণ ক্ষমতা ছিল ১৫ জনের, কিন্তু সেটিতে অতিরিক্ত আটজন যাত্রী ছিল।
অনেক মিডিয়া লিখেছে অতিরিক্ত যাত্রী থাকার কারণে আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়লে ক্যাপ্টেনের পক্ষে নৌকাটি ঠিকমত সামলানো সম্ভব হয়নি।
সরকারি ম্যাজিস্ট্রেটরা তদন্ত করে দেখছেন কেন নৌকায় অতিরিক্ত লোক তোলা হয়েছিল, এবং কেন খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও নৌকাটি ছেড়ে গিয়েছিল।
মি. নোসিরিনো বলেন নৌকাটি ঠিকমত নিরাপত্তা প্রটোকল মেনেছিল কিনা, ঠিকমত সেটির রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো কিনা, এবং সেইসাথে সেটির অনুমতিপত্র এবং ইনস্যুরেন্স পরীক্ষা করে দেখা হবে।
তবে, নৌকাটিকে কী হচ্ছিল এবং ঠিক কারা সেখানে ছিল তা নিয়ে অনেক কিছু যেহেতু অস্পষ্ট, ফলে এই এই দুর্ঘটনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সহজে শেষ হবেনা।
ইটালির সেনা পুলিশ বাহিনী কারাবিনিয়েরি এই তদন্তে সাহায্য করছে। তারা বিবিসিকে বলেছে নৌকা এবং আবহাওয়ার বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবে, কিন্তু কারা নৌকায় ছিল সেটি নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে না।