শেয়ার বাজার

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অগ্রাধিকার – মোস্তাফিজুর রহমান

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অগ্রাধিকার – মোস্তাফিজুর রহমান
অর্থনীতি সাক্ষাৎকার

বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক কর্মসূচি বিস্তৃত করার বিষয়সহ বড় পাঁচটি চ্যালেঞ্জ দেখছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ রুমী।

প্রশ্ন : আসন্ন বাজেটে বড় ধরনের কী কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিস্তৃত করা, তৃতীয় চ্যালেঞ্জ ঘাটতি অর্থায়ন কিভাবে করা হবে সেটা ঠিক করা। চতুর্থ চ্যালেঞ্জ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য প্রকল্প বাছাই। এবার তো কিছুটা আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই করতে হবে।

পঞ্চমত সংস্কার কর্মসূচি। বিশেষত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) শক্তিশালী করে সম্পদ আহরণ বাড়ানো। এনবিআরকে যে টার্গেট দেওয়া হবে, প্রকৃত সম্পদ আহরণের পরিপ্রেক্ষিতে তা বেশ বড় টার্গেটই হবে মনে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচি আছে, যেগুলো এবারের বাজেটে করতে হবে। সুদের হার, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার—এগুলোকে বাজারভিত্তিক করতে হবে। সেই বিষয়গুলোও বাজেটে থাকবে।

সেটা করতে গেলে অর্থনীতিতে যে অভিঘাত হবে, সেটাকে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে গেলে হয়তো কিছুটা মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। আর সুদহার বাজারভিত্তিক করলে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সেগুলো সামাল দেওয়া এবারের বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন  : বাজেটের চ্যালেঞ্জগুলো কিভাবে সামাল দেওয়া যায়?

মোস্তাফিজুর রহমান : সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির যে সমস্যাগুলো, তার মূলে রয়েছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা। এ ছাড়া কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নে সঠিক যে তথ্য-উপাত্ত দরকার, তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

সঠিকভাবে সুবিধাভোগী নির্বাচনে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কর্মসূচির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণেও আমাদের দুর্বলতা আছে।

এবারের বাজেটে যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হবে, তাতে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব পড়বে। এসব চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কিছুটা বিস্তৃতি লাগবে। একই সঙ্গে এর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। বাস্তবায়ন শক্তিশালী করতে হবে। যারা পাচ্ছে, তাদের পাশাপাশি আরো নতুন মানুষকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

প্রশ্ন  : অন্য বছরের বাজেটের চেয়ে এবারের বাজেটটি নির্বাচনপূর্ব বাজেট। নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও তা কি জনতুষ্টিমূলক হবে বলে আপনি মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : আমাদের রাজস্ব আহরণের যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেটাকে শক্তিশালী করতে হবে। নির্বাচনী বছরে জনতুষ্টিমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। অর্থনীতি যে রকম চাপের মধ্যে আছে, সেই বাস্তবতা মাথায় রাখলে এটা কঠিন হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি হয়তো কিছুটা বাড়তে পারে। এটাকে পপুলিস্ট একটা পদক্ষেপ বলে মনে করা হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য বার প্রকল্প বাড়ানো, এমপিদের বাড়তি প্রকল্প দেওয়া—সেই পথে না গিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, প্রবৃদ্ধির আগের ধারা সেটাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। নির্বাচনী বছর বলে এমন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নেওয়া ঠিক হবে না। বর্তমানে অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যালান্স অব পেমেন্ট, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভসহ বিভিন্ন সূচক স্থিতিশীল নয়। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করি।

প্রশ্ন  : আইএমএফের ঋণের কিছু শর্ত আছে, যেগুলো পূরণ করে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া কতটা সম্ভব?

মোস্তাফিজুর রহমান : আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কার, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনাসহ আইএমএফের বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ আছে। এটার একটা চাপ তো থাকবেই। যেমন আইএমএফ বলেছে, পয়েন্ট ৫ শতাংশ করে রাজস্ব বাড়াতে হবে। সেটা করতে গেলে আমাদের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়বে। বাস্তবে এই বছরে যে রাজস্ব সংগ্রহ করা হচ্ছে, তার চেয়ে একটা বড় জাম্প দিতে হবে।

প্রশ্ন  : বর্তমান পরিস্থিতিতে রিজার্ভ নিয়ে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা কিভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে?

মোস্তাফিজুর রহমান : আমরা মার্চ মাসেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারিনি। রিজার্ভের যে প্রবণতা, তাতে জুনের মধ্যে নিট রিজার্ভ ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার নিশ্চিত করা খুবই কঠিন হবে। সরকারের নানা পদক্ষেপে আমদানি কমেছে। কিন্তু বর্তমানে জ্বালানি খাত নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এবং ঈদের ভোগ্য পণ্য আমদানিতে ডলার লাগবে। আমদানি আরো কমিয়ে কিংবা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল কমিয়ে হয়তো সেটা করতে পারে। কিন্তু অর্থনীতির ওপর কী চাপ সৃষ্টি করবে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দুটিই করতে হবে।

প্রশ্ন  : অনেক সক্ষম মানুষ আয়কর দিচ্ছেন না। আবার যাঁরা কর দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর চাপ বাড়ছে। এই বাস্তবতায় এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে কি?

মোস্তাফিজুর রহমান : যার করসীমা পর্যন্ত আয় নেই, তার ওপর তো কর বসানো যৌক্তিক হবে না। যাঁরা রিটার্ন দাখিল করবেন, তাঁদের ওপর এনবিআর হয়তো কোনো ধরনের ফি বা চার্জ রাখতে পারে। টিআইএন নাম্বার যাঁদের আছে, তাঁদের কর দেওয়া উচিত। করখেলাপ যেখানে আছে, সেখানে যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে নতুন করদাতা সন্ধান করতে হবে। ভিত্তি আরো বিস্তৃত করে এটা করতে হবে। যেমন আমরা বলি আড়াই কোটি মানুষ হোল্ডিং ট্যাক্স দেন। কিন্তু সেখানে টিআইএন নাম্বার আছে ৮৭ লাখ মানুষের। তার মধ্যে ৫০ লাখ মানুষও আয়কর দাখিল করেন না। যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই শূন্য আয় দেখান। সেই হিসাবে মাত্র ২০ লাখ মানুষ আয়কর দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে ডিজিটাইজেশনসহ বেশ কিছু শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।