ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই এখন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ খবর। ভারতের সঙ্গে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির আশ্বাস, গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা – এসব খবর যেমন তাতে আছে, তেমনই গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে মি. মোদীর উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু রাজনীতিবিদ যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলিও।
আবার মি. মোদীর সফরকালে যেসব প্রতিবাদ হয়েছে, তাও জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন ভারতের বাজার এবং চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতকে পাশে পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকেই সামরিক, বেসামরিক, গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে যেমন চুক্তি হয়েছে, তেমনই নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে ভারতে যেভাবে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে, বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন বেড়েছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিরিখে অনেকটা পিছিয়ে গেছে ভারত, সেইসব প্রশ্ন বেসরকারি মহল এবং রাজনীতিবিদদের তুলতে বাধাও দেয় নি জো বাইডেন প্রশাসন।
‘প্রতিরক্ষা সম্পর্কে মাইলফলক’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণার পরে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন দুই দেশের প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পর্কে মি. মোদীর এই সফর মাইলফলক হয়ে থাকবে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো ইরফান নূরুদ্দিন মনে করছেন “যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির দিকে ভারতের ঝুঁকে পড়ার অর্থ হল এবার চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি যুঝতে হবে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে চীনকে। আর এখন ভারত মহাসাগর অঞ্চলেও যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের যৌথ প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হবে চীনকে। আবার ভারত সীমান্তেও যুক্তরাষ্ট্রের কারিগরি সহায়তা নিয়ে তৈরি হওয়া সরঞ্জাম থাকবে, সেখানেও চীনের সামনে কঠিন লড়াই।“
সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে গত নয় বছরে যিনি কোনও সাংবাদিককে প্রশ্ন করার সুযোগই দেন নি, সেই নরেন্দ্র মোদীকে এবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ২০১৬ সালে একবার মাত্র তিনি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, কিন্তু সেখানেও কারও কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সম্মেলন নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিতে লেখা হয়েছে যে সফরের জন্য বিমানে ওঠার আগে পর্যন্তও মি. মোদী সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তাকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
তার উদ্দেশ্যে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকি প্রশ্ন করেছিলেন যে মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার উন্নত করতে এবং ভারতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কী কী পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
মি. মোদী তার জবাবটা শুরুই করেন এইভাবে: “আমি অবাক হচ্ছি এটা শুনে যে আপনি বলছেন লোকে বলে... না ভারত আসলেই একটি গণতন্ত্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেমন বলছিলেন ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই ডিএনএতে গণতন্ত্র আছে।
নরেন্দ্র মোদী আরও বলেন যে ভারতে জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের কোনও স্থান নেই।
ভারতের মুসলমানদের প্রসঙ্গ তুললেন বারাক ওবামা
নরেন্দ্র মোদী যখন রাষ্ট্রীয় অতিথির সম্মান পেয়ে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নানা চুক্তি চূড়ান্ত করছেন, সেই সময়েই ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
সিএনএনের জনপ্রিয় উপস্থাপিকা ক্রিশ্চিয়ান আমানপুরকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মি. ওবামা বলেন যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা হলে তিনি কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন।
মি. ওবামার কথায়, “হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমানদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়। আমার সঙ্গে যদি মি. মোদীর কথা হতো তাহলে আমি বলতাম যে আপনি যদি সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত না রাখতে পারেন তাহলে ভবিষ্যতে বিভাজন আরও বাড়বে। এটা ভারতের স্বার্থের বিপরীতেই যাবে।“
বারাক ওবামার মন্তব্য নিয়ে ভারতে প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভারতের সামাজিক মাধ্যমে।
কংগ্রেস নেত্রী সুপ্রিয়া শ্রীনেৎ মি. ওবামার ওই সাক্ষাতকারের একটি অংশ টুইট করে মন্তব্য করেছেন “মি. মোদীর বন্ধু বারাক ওবামা একটা বার্তা দিয়েছেন। মনে হচ্ছে তিনিও বোধহয় মি. মোদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। অন্তত ভক্তরা তো সেই দাবী করতেই পারে।“
অর্পিত মারওয়াহ নামে এক টুইট ব্যবহারকারী লিখেছেন, “যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো হচ্ছে, ওবামা জেনে শুনেই অপপ্রচার চালাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে পুরোপুরি ভরসা করা যায় না। তারা একই সঙ্গে দুটো পক্ষের (দক্ষিণপন্থী এবং বামপন্থী) মানুষদেরই খুশি করছে।“
মি. সিনহা নামে আরেক টু্ইট ব্যবহারকারী লিখেছেন, “বারাক হুসেইন ওবামার শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্র লাখো মুসলমানকে হত্যা করিয়েছেন, ডজনখানেক ইসলামী দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে.. সবই জ্বালানি তেলের প্রয়োজনে.. আর এখন তিনি ভারতের মুসলমানদের নিয়ে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছেন।“
নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ বা সংবাদ মাধ্যমগুলোই করছে, তা নয়।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে মি. মোদীর শাসনকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলির মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে সহিংসতার ঘটনাও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্বৈত নীতি’
প্রশ্ন উঠছে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় অতিথির সম্মান দিচ্ছে, হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো হচ্ছে, কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন মি. মোদী, তখন সেদেশের ভেতরেই কেন তিনি সমালোচিত হচ্ছেন?
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক ইমন কল্যান লাহিড়ীর কথায়, “মি. মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে, তার দুটো দিক আছে। প্রথমত এই সফরের সার্থকতা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরতে চেয়েছেন যে ভারতের গণতন্ত্র সুরক্ষিতই আছেন, তা ক্ষুণ্ণ হয় নি। অন্যদিকে চীনের প্রভাব আটকানো এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের যে বিস্তার, তার মোকাবিলা করতে গেলে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন।
“তাই ভারতকে যেমন অস্বীকার করার জায়গায় নেই যুক্তরাষ্ট্র, আবার তাদের দেশের ভাবমূর্তি যেন তাদের দেশের মানুষের কাছে ক্ষুণ্ণ না হয়, তাই মি. মোদীর বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলোকেও সামনে আসতে দেওয়া হচ্ছে,” বলছিলেন অধ্যাপক লাহিড়ী।
সেজন্যই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর চলাকালে এরকম একটা দ্বৈত নীতি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এমনটাই মত অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ীর।