শেয়ার বাজার

বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান চালানোর আইনগত ভিত্তি কী?

বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান চালানোর আইনগত ভিত্তি কী?
মতামত

বাংলাদেশে সম্প্রতি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামে একটি শিক্ষা বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে নানা ধরণের অভিযোগ ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এই বিতর্কের পক্ষে একদল অভিযোগ তুলেছে যে, বিদ্যানন্দের কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা এবং অনিয়ম রয়েছে। অন্য দল বলছে, এই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই এমন প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কার্যক্রমে সুবিধাভোগী হিসেবে উপস্থাপন এবং বঙ্গবাজারের আগুনে পোড়া কাপড়ের গয়না তৈরি নিয়ে অভিযোগ ও সমালোচনা হয়।

তবে প্রতিষ্ঠানটি বরাবরই এ ধরণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হলে নিবন্ধন থাকাটা বাধ্যতামূলক। স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সম্পর্কিত বেশ কিছু আইনও রয়েছে।

একই সাথে এসব প্রতিষ্ঠান গঠন, পরিচালনা এবং তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। কোন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ারও এসব প্রতিষ্ঠানের রয়েছে।

বাংলাদেশের সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৮টি জেলা থেকে এ পর্যন্ত ৬৯,৯৯৬টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ৫২৮৫টি এতিমখানাও রয়েছে।

এসব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়ন করে বলেও জানানো হয়।

যেভাবে নিবন্ধন হয়

বাংলাদেশে কোন প্রতিষ্ঠানকে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করতে হলে প্রথম ধাপ হলো সেটির নিবন্ধন করা।

নিবন্ধন নিতে হলে সমাজ সেবায় ওই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের পাশাপাশি কী ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায় এবং তার একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করতে হবে।

বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দেয় এরকম বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, ফাউন্ডেশন এবং এতিমখানার মত জনকল্যাণমুখী এজেন্সির নিবন্ধন দিয়ে থাকে সমাজসেবা অধিদপ্তর।

স্বেচ্ছাসেবমূলক ১৫ ধরণের কার্যক্রমের জন্য এই নিবন্ধন দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিশু কল্যাণ, যুব কল্যাণ, নারী কল্যাণ, শারীরিক ও মানসিক অসমর্থ ব্যক্তিদের কল্যাণ, পরিবার পরিকল্পনা, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ থেকে জনগণকে বিরত রাখা, সামাজিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, ভিক্ষুক ও দুস্থদের কল্যাণ ইত্যাদি।

তবে সমাজসেবা অধিদপ্তর ছাড়াও বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান এই নিবন্ধন দেয় সেগুলো হচ্ছে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর, সমবায় অধিদপ্তর, রেজিষ্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি-আরজেএসসি, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এবং মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি।

তবে কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে হবে সেটি নির্ভর করবে যে, নিবন্ধনপ্রার্থী প্রতিষ্ঠানটি সমাজকল্যাণে কী ধরণের কাজ করতে চায় তার উপর।

সমাজসেবামূলক কার্যক্রম চালাতে হলে দুটি আইনের অধীনে নিবন্ধন করানো যায়। একটি হচ্ছে ১৯৬১ সালের স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) ৪৬নং অধ্যাদেশ। এই অধ্যাদেশের আওতায় নিবন্ধন দিয়ে থাকে সমাজসেবা অধিদপ্তর।

এই অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক হেলাল উদ্দিন ভূঞা বলেন, কোন প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দেয়ার সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান আবেদন করে প্রথমে তার নামের একটি ছাড়পত্র দেয়া হয়। আর এর আগে হয় ভেরিফিকেশন বা যাচাই।

যাচাইয়ের পর আবেদন চাওয়া হয় নিবন্ধনের জন্য। এই আবেদনও যাচাই করা হয় এবং এতে ইতিবাচক তথ্য উঠে আসলে তারপরই নিবন্ধন বা রেজেস্ট্রেশন দেয়া হয়।

“রেজিস্ট্রেশন দেয়ার পর তার একটা অ্যাপ্রুভাল গঠনতন্ত্র থাকে। সেই গঠনতন্ত্রের বর্হিভূত কোন কাজ যদি সে করে বা সে সম্পর্কিত কোন অভিযোগ যদি আসে সেটাতো আমরা খতিয়ে দেখি এবং আমরা ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করি।”

আর দ্বিতীয়তটি, ১৯৯৪ সালের কোম্পানী আইন। এই আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেজিষ্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি-আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেয়া যায়।

বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তুলনায় আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেয়ার হার বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

তবে, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বাংলাদেশের বাইরে থেকে আসা সাহায্য বা বৈদেশিক অর্থ বা অনুদান ব্যবহার করতে চায় তাহলে তাকে অতিরিক্ত আরেকটি নিবন্ধন করাতে হবে। আর এই নিবন্ধনটি দেয়া হয় বাংলাদেশের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে।

এনজিও বিষয়ক ব্যুরোটি পরিচালিত হয় বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন ২০১৬ এর অধীনে। এই আইন অনুযায়ী, ব্যুরোর কাছ থেকে নিবন্ধন গ্রহণ ছাড়া কোন সংস্থা বা এনজিও বৈদেশিক অনুদান গ্রহণ করে কোন স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা করতে পারবে না।

তবে কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনার জন্য বৈদেশিক অনুদান নিতে চান তাহলে তাকে নিবন্ধন করাতে হবে না। তবে অবশ্যই ওই ব্যুরোর কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।

নিবন্ধন নেয়ার মানে হচ্ছে যে, সরকারের কাছে তথ্য থাকে যে, ওই প্রতিষ্ঠানটি কী ধরণের কাজ অর্থাৎ দাতব্য, স্বেচ্ছাসেবী, নাকি স্বল্পমূল্যে সেবা দিচ্ছে ইত্যাদি।

আর এসব কাজের জন্য আয়কর আইনের ৬ উপধারা অনুযায়ী, কর সুবিধা বা কর রেয়াত পাওয়ার বিধান রয়েছে।

কিভাবে হয় নজরদারি?

কোন স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান যে কার্যক্রম পরিচালনা বা যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উল্লেখ করে নিবন্ধন করে তা যথাযথভাবে পালন করছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব হচ্ছে যে প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন দেয় তার উপর।

নিবন্ধন শর্তের মধ্যেই উল্লেখ থাকে যে, প্রতি বছর ওই প্রতিষ্ঠানটিকে অডিট করাতে হবে, এই অডিট প্রতিবেদন প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক সভায় আলোচিত হবে এবং পরে সেটা নিবন্ধন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা দিতে হবে।

একই সাথে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায় কারা থাকছেন, কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে নিবন্ধন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হবে।

কেউ যদি কয়েক বছর ধরে অডিট প্রতিবেদন জমা না দেয় তাহলে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার নিয়ম রয়েছে।

এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক হেলাল উদ্দিন ভূঞা বলেন, কোন প্রতিষ্ঠান ঠিক মতো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়।

তিনি বলেন, “প্রত্যেক জেলার ডিডি (ডেপুটি ডিরেক্টর) মহোদয় আছেন উনারা দেখেন, উপজেলা অফিসার আছেন উনারা দেখেন, মাঝে মাঝে আমরাও যাই, আমাদের বিভাগীয় কার্যালয় আছে সেখান থেকে কর্মকর্তারা যান।”

“হান্ড্রেড পার্সেন্ট সবসময় যাওয়া সম্ভব হয়, ঠিক তা না, বাট মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা আছে। সব শেষের কথাটা হচ্ছে মনিটরিং করা হয়।”

কোন ব্যক্তি যদি কোন দাতব্য বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে দান করেন তাহলে তার দেয়া অর্থ কিভাবে ব্যয় করা হচ্ছে তা জানার উপায় হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠানের অডিট প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনেই প্রতিষ্ঠানটির আয় ও ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব উল্লেখ থাকে।

মি. ভূঞা বলেন, কোন এনজিও কারো কাছে টাকা চাইতে পারবে না। তবে কোন ব্যক্তি যদি দান করেন তাহলে তিনি অবশ্যই ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বা কোন রেকর্ডের মাধ্যমে করেন। অডিট প্রতিবেদনে এসব কার্যক্রমেরই বিস্তারিত উল্লেখ থাকে বলে জানান তিনি।

স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করে থাকে। মি. ভূঞা জানান, কোন প্রতিষ্ঠান যখন নিবন্ধন নেয়, তখন তার নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যেই উল্লেখ থাকে যে কোথা থেকে অডিট করাতে হবে। এটা ওই প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রের অংশ।

তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের জেলা ডেপুটি ডিরেক্টরের কার্যালয়, উপজেলা কর্মকর্তা, বা অন্য যেকোন সিএ ফার্ম থেকে এই অডিট করানো হয়।

এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক এসকেএম মনিরুজ্জামান বলেন, নিবন্ধনকৃত কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আসলে তা তদন্ত করা হয়। তদন্তের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।

“অপরাধের গভীরতা অনুযায়ী কারো প্রজেক্ট স্থগিত করা হয়, ইভেন কারোর যদি প্রয়োজন মনে হয় তার নিবন্ধন বাতিল করতে হবে, সে এদেশে কাজ করতে পারবে না, তাহলে নিবন্ধন বাতিল পর্যন্ত করা হয়।”