পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগে অনেকেরই জানার আগ্রহ থাকে কোন কোন কোম্পানি ‘ভালো’। তাদের প্রশ্ন থাকে ভালো কোম্পানি চেনার উপায় কী? বলতে গেলে ‘ভালোর কিন্তু শেষ নেই’; তবে খারাপের শেষ আছে।
ভালো কোম্পানি বললে আমাদের আগে দেখতে হবে তারা কী কী প্রোডাক্ট বা সার্ভিস বাজারে দিচ্ছে এবং সেটা সহজলভ্য কি না। একইসঙ্গে ওই কোম্পানির প্রোডাক্টে বা সার্ভিসে ভোক্তারা সন্তুষ্ট কি না। ভালো কোম্পানি চেনার ক্ষেত্রে এই দুটো বিষয় সাধারণ মূল্যায়নের প্রথম পর্যায়।
দেশি-বিদেশি শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে শেয়ার ব্যবসায় লাভবান হওয়ার কিছু মৌলিক কৌশল তুলে ধরা হলো। তবে সব সময় যে এসব বিষয় কার্যকর ফল দেবে এমন নাও হতে পারে। বিশেষ করে স্বল্প মেয়াদে কাঙ্খিত ফল পাওয়া মুশকিল হতে পারে। তবে বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বিনিয়োগ করা হলে দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
১। শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত (P/E Ratio):
পিই রেশিও ২০ এর কম হওয়া ভালো। পিই রেশিও যত কম হয়, বিনিয়োগে ঝুঁকি তত কম। মূল্য-আয় অনুপাত হচ্ছে একটি কোম্পানির শেয়ার তার আয়ের কতগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে তার একটি পরিমাপ। শেয়ারের পিই যতো কম হবে, বিনিয়োগ ঝুঁকিও ততো কম হবে। আর পিই যতো বেশি হবে, বিনিয়োগ ঝুঁকিও ততো বেশি হবে।
সাধারণত ২০-এর কম পিই রেশিওর শেয়ারে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করা হয়। আর ৪০-এর বেশি পিই রেশিওর শেয়ারে বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়।
২। শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (NAV):
সম্পদ মূল্যের সাথে বাজারমূল্যের একটা সামঞ্জস্য থাকা উচিত। যদিও কোম্পানির অবসায়ন (বিলুপ্তি) না হলে সম্পদ মূল্যে বিনিয়োগকারীর কার্যত কিছু যায় আসে না। কোম্পানির অবসায়ন হলেই কেবল শেয়ারহোল্ডাররা ওই সম্পদের কিছুটা ভাগ পেতে পারেন। এক্ষেত্রেও সম্পদ বিক্রির মূল্য থেকে আগে ব্যাংক ঋণ এবং অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করা হয়। এরপর কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
৩। শেয়ার প্রতি আয় (EPS):
তালিকাভুক্ত কোম্পানির ইপিএস যত বেশি হবে, বিনিয়োগের জন্য ততো বেশি উপযুক্ত বা ভালো মনে করা হয়। কারণ ইপিএস বেশি হলে কোম্পানির বেশি ডিভিডেন্ড দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। আর ইপিএস কম হলে কোম্পানির ডিভিডেন্ডের সক্ষমতাও কমে যায়।
৪। শেয়ারের সংখ্যা:
কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা দেখুন কতটুকু ফ্লোটিং বা লেনদেনযোগ্য। চাহিদা-যোগানের সূত্র অনুসারে লেনদেনযোগ্য শেয়ার সংখ্যা কম হলে তার মূল্য বাড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অন্যদিকে লেনদেনযোগ্য শেয়ার সংখ্যা বেশি হলে বাজারে তা অনেক বেশি সহজলভ্য হয়। এছাড়া, বিনিয়োগের সময়ে প্রতিদিন ভালো অঙ্কের শেয়ার লেনদেন হয় এমন কোম্পানির শেয়ার কেনা ভালো। রণ কোনো কারণে জরুরী ভিত্তিতে টাকার প্রয়োজন হলে সহজেই শেয়ার বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু নিয়মিত লেনদেন হয় না এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করা হলে জরুরিভিত্তিতে বিনিয়োগ প্রত্যাহার সম্ভব নয়।
৫। অনুমোদিত মূলধন (authorized capital) আর পরিশোধিত মূলধন (paid-up capital) এর রেশিও:
অনুমোদিত মূলধন ও পরিশোধিত মূলধনের রেশিও বা পরিমাণ কাছাকাছি থাকলে বোনাস ও রাইট শেয়ার ইস্যু করা বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিকে আগে অনুমোদিত মূলধন বাড়াতে হবে। বোনাস ডিভিডেন্ডে যেসব বিনিয়োগকারীর বিশেষ ঝোঁক রয়েছে তাদের উচিত এসব বিষয় দেখা নেওয়া।
৬। ডিভিডেন্ড ঈল্ড (Dividend Yeild):
শেয়ারের বাজার মূল্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি হতে পারে। তাই লভ্যাংশের হার প্রকৃত রিটার্ন নির্দেশ করে না। ডিভিডেন্ড ঈল্ডই শেয়ারের সঠিক রিটার্ন। বাজার মূল্যের ভিত্তিতে প্রাপ্য লভ্যাংশ বিনিয়োগের কত শতাংশ তা-ই হচ্ছে ডিভিডেন্ড ইল্ড। ঘোষিত ডিভিডেন্ডকে ১০০ দিয়ে গুণ করে সংশ্লিষ্ট শেয়ারের বাজার মূল্য দিয়ে ভাগ করলে ডিভিডেন্ড ইল্ড পাওয়া যায়। এ ইল্ড যত বেশি হবে বিনিয়োগকারীর প্রাপ্তিও তত বাড়বে।
৭। ডিভিডেন্ড ট্র্যাক রেকর্ড:
গত ৩-৪ বছরের ট্র্যাক রেকর্ড দেখুন। কোম্পানিটি কী পরিমাণ ডিভিডেন্ড দেয় তা দেখুন। বার্ষিক গড় মূল্য দেখুন। চেষ্টা করুন এই মূল্যের কাছাকাছি দামে শেয়ার কেনার।
৮। মুনাফার ট্র্যাক রেকর্ড:
গত ৩-৪ বছরের মুনাফার ট্র্যাক রেকর্ড দেখুন। কোম্পানিটি কী পরিমাণ মুনাফা করছে, তা দেখুন। বছরভিত্তিক মুনাফার পার্থক্য দেখুন।
৯। শেয়ারে অংশগ্রহণ:
স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতি মাসে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, বিদেশি বিনিয়োগকারী ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারে অংশগ্রহণ দেখানো হয়। এতে দেখুন উদ্যোক্তা পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগের কোন পরিবর্তন হচ্ছে কীনা। এই পরিবর্তনের উপর শেয়ারটির দর উঠা-নামা করতে পারে।
১০। কোম্পানির গুড উইল:
আপনি যে কোম্পানির শেয়ার কিনবেন সে কোম্পানির গুড উইল ও তার পরিচালকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকটাও বিবেচনায় নিতে হবে। একটি কোম্পানি কতটুকু ভালো ব্যবসা করবে, ব্যবসার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা কতটুকু তা নির্ভর করে এর উদ্যোক্তাদের দূরদর্শীতা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার উপর।
একইভাবে মুনাফার সবটুকু হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হবে কি-না, লভ্যাংশের ক্ষেত্র অতিমাত্রায় রক্ষণশীল হবে, না-কি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হবে তাও নির্ভর করে তাদের উপর।
মনে রাখতে হবে, বিক্রির সময় নয়, বরং কেনার সময়ই লাভের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ ভালো দামে শেয়ার কিনতে পারলে ভালো লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। কেনার সময় দাম বেশি পড়ে গেলে লাভের সম্ভাবনা একটু হলেও কমে আসবে।