জীবন বীমায় গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধের হার কিছুদিন খানিকটা স্বস্তির দিকে যাচ্ছিল। এখন আবার বীমা খাতে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে। গত তিন বছরে দেশে জীবন বীমার দাবি পরিশোধের হার ক্রমাগত কমছে। ২০১৮ সালে বীমা দাবি অনিষ্পন্ন ছিল সর্বনিম্ন ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। এরপর থেকে বীমা দাবি অনিষ্পন্নের হার ঊর্ধ্বমুখী। ২০২২ সালে এসে যা দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশে। টাকার হিসাবে গত বছর অনিষ্পন্ন বীমা দাবির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্য মতে, ২০০৯ সালে বীমা দাবি পরিশোধের হার ছিল ৭১ দশমিক ৯১ শতাংশ। এরপরের বছরগুলোয় বীমা দাবি পরিশোধের হার ক্রমাগত বাড়ছিল। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ বীমা দাবি ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ পরিশোধ করা হয়। এরপর থেকে ক্রমাগত কমতে শুরু করেছে বীমা দাবি পরিশোধ। ২০১৯ সালে তা দশমিক ৫১ শতাংশ কমে ৮৮ দশমিক ৮৮ শতাংশে দাঁড়ায়। পরবর্তী বছরও আরো কমে ৮৪ দশমিক ৮২ শতাংশ, ২০২১ সালে এসে তা ৭০ দশমিক ৪০ শতাংশে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২২ সালে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়, যা বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
২০২০ সাল থেকে অর্থের হিসাবে প্রতি বছরই বড় অংকের বীমা দাবি অপরিশোধিত থেকে যাচ্ছে। ২০০৯-১৯ পর্যন্ত অনিষ্পন্ন দাবির অর্থের পরিমাণ ছিল প্রতি বছর ৪০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার মধ্যে। গত তিন বছরে এ সংখ্যা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ২০২০ সালে ১ হাজার ১৮২ কোটি, ২০২১ সালে ৩ হাজার ৪৯৯ কোটি এবং গত বছর ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকার বীমা দাবি অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে।
আইডিআরএর একটি সূত্র জানায়, দেশের জীবন বীমা খাতে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৫টি। কিছু প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের পলিসির বিপরীতে পর্যাপ্ত বীমা দাবি নিষ্পত্তি হচ্ছে না। নিষ্পত্তির এ হারকে সন্তোষজনক নয় বলে এক গবেষণায় জানিয়েছে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি (বিআইএ)। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারণেই দাবি পরিশোধের হার ক্রমাগত নিম্নমুখী। এসব প্রতিষ্ঠানের তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকা এবং নিজেদের অনিয়মের কারণে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না তারা। গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ করতে না পারায় এরই মধ্যে তিনটি বীমা প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো- সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
আইডিআরএ সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে মোট বীমা দাবি আসে ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৯৩০টি। এর বিপরীতে পরিশোধ করা হয় ১৮ লাখ ৯২ হাজার ৯৯২টি। সে হিসাবে অনিষ্পন্ন থেকে গেছে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ বীমা দাবি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিশোধ করা হয়েছে গোষ্ঠী ও স্বাস্থ্য দাবি। এরপর রয়েছে মৃত্যু দাবি, সার্ভাইভাল বেনিফিট দাবি ও মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি। সবচেয়ে কম পরিশোধ করা হয়েছে সারেন্ডার দাবি। সে বছর ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৩ দাবির মধ্যে ৮৫ হাজার ১০২টি দাবি নিষ্পন্ন করা হয়। অথচ ২০২১ সালে সারেন্ডার দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগের বছরগুলোয়ও সারেন্ডার দাবি ৯৬ শতাংশেরও বেশি নিষ্পত্তি করা হয়।
২০২২ সালে জীবন বীমায় মোট দাবি ছিল ১৩ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। দাবি পরিশোধ করা হয় ৯ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ১১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা বীমা দাবি থাকলেও পরিশোধ করা হয় ৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ৭ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা বীমা দাবি করলে ৬ হাজার ৭৪১ কোটি টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়।
আইডিআরএর গত ১৪ বছরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সর্বনিম্ন ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ দাবি অনিষ্পন্ন ছিল ২০১৮ সালে। অন্য বছরগুলোয় এ হার বাড়তে থাকে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ দাবি অনিষ্পন্ন থেকে যায় ২০২২ সালে। ২০০৯ সালে দাবি অনিষ্পন্ন ছিল ২৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। পরের বছর ২০১০ সালে ২৪ দশমিক ৫৮, ২০১১ সালে ২৩ দশমিক ৯৫, ২০১২ সালে ২৩ দশমিক ৭৯, ২০১৩ সালে ২১ দশমিক ৭২, ২০১৪ সালে ১৯ দশমিক ৫৯, ২০১৫ সালে ১৪ দশমিক ৭১, ২০১৬ সালে ১৪ দশমিক ১২, ২০১৭ সালে ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ দাবি অনিষ্পন্ন থাকে। ২০১৮ সালের পর অনিষ্পন্ন দাবির হার আবার বাড়তে থাকে।
‘বাংলাদেশের জীবন বীমা শিল্পে দাবি নিষ্পত্তির দৃশ্যকল্প’ শীর্ষক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে বিআইএ। বিআইএ পরিচালক এসএম ইব্রাহিম হোসাইন গবেষণার জন্য ৩৫টি বীমা কোম্পানির কাছ থেকে তথ্য চাইলে মাত্র ২৬টি প্রতিষ্ঠান তথ্য সরবরাহ করে। ওই গবেষণায় দাবি নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহে বিলম্ব, মৃত্যুসনদ দিতে বিলম্ব, স্বাক্ষরহীন দাবিপত্র, নমিনি উল্লেখ না থাকা, তামাদি হয়ে যাওয়া, এজেন্টের সহযোগিতা না থাকার মতো বিষয়গুলো বীমা দাবি নিষ্পত্তি না হওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া পলিসি নবায়ন, কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা না থাকার কারণে কিছু প্রতিষ্ঠানের দায়ভার পুরো শিল্পের ওপর পড়ে। যার কারণে পর্যাপ্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির পরিচালক এসএম ইব্রাহিম হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জীবন বীমা খাতের অধিকাংশ পলিসি তামাদি হয়ে যায়। ১০০টি পলিসি গ্রহণ করা হলে তার মধ্যে মাত্র ৪০টি পলিসি টিকে থাকে। যার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ফান্ড গঠন করতে পারে না। এর ওপর প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও অনেক বেশি। ফান্ড গঠন করতে না পারার কারণে তাদের গ্রাহকের অর্থ যথাসময়ে পরিশোধ করার কোনো সুযোগ থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘কোনো বীমা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা অপরিশোধিত রাখতে চায় না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান তহবিল গঠন করতে না পারলে গ্রাহককে টাকা দেবে কোথা থেকে? তখন গ্রাহকও প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে আস্থা হারান। লাইফ বীমা খাতে ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ অবস্থায় আছে। এর মধ্যে আট-নয়টির অবস্থা ভীষণ খারাপ।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইডিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক উপস্থিত থাকলে তার সম্মানি যা, তার থেকে ১০ গুণ বেশি টাকা নিয়ে যায়। যার ব্যয়ভার পড়ে প্রতিষ্ঠানের ওপর। এতে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধি পায়, ফান্ডে সংকট দেখা দেয়। বীমা দাবি পরিশোধ করতে না পারার অন্যতম একটি কারণ এটি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বেনজীর ইমাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘করোনার কারণে বীমা খাতের তেমন ক্ষতি হয়নি। মূলত করোনার পর প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে বিনিয়োগ করেছে। যেখান থেকে প্রত্যাশিত কোনো আয় পাচ্ছে না। ফলে যথাসময়ে গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করতে পারছে না। এছাড়া জবাবদিহিতার অভাবও এর বড় কারণ।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া গ্রাহকের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকে না অনেক প্রতিষ্ঠানের। যার বড় কারণ গ্রাহক হয়রানি। সাধারণত একক ব্যক্তি হিসেবে গ্রামের নারীরা সবচেয়ে বেশি পলিসি ইস্যু করে। কিন্তু তারা এত ডকুমেন্টস বোঝে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলার পাশাপাশি গ্রাহকের বুঝতে না পারা, এজেন্টের হয়রানি গ্রাহকের মধ্যে অনাস্থা তৈরি করে। তাতে করে অনেক পলিসি তামাদি হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি বীমা শিল্পের জন্য ইতিবাচক নয়।’
বীমা দাবি পরিশোধের বিষয়ে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এসএম জিয়াউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বীমা দাবি পরিশোধ করা হয় না—বিষয়টি এমন নয়। গ্রাহক যে পলিসি গ্রহণ করে তার বিপরীতে সব দাবিই নিষ্পত্তি করা হয়। কিছু বীমা দাবি নিষ্পত্তিতে সময়ক্ষেপণ হয়। অনেক ক্ষেত্রে এটা গ্রাহকেরও সমস্যা। গ্রাহকের কাছ থেকে যে কাগজপত্র চাওয়া হয়, তারা তা দিতে পারেন না। কিছু প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে অর্থ সংকট থাকার কারণে এ ধরনের সমস্যার তৈরি হয়। যার প্রভাব পড়ে পুরো বীমা শিল্পের ওপর।’