শেয়ার বাজার

দেশের অর্থনীতির এখন বহুমাত্রিক সংকটে

দেশের অর্থনীতির এখন বহুমাত্রিক  সংকটে
জাতীয় অর্থনীতি

দেশের অর্থনীতির সংকট এখন বহুমাত্রিক বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘‌অর্থনীতির খারাপ পরিস্থিতির জন্য এখন শুধু কভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করার সময় আর নেই। বর্তমানে বৈদেশিক বাণিজ্যের চেয়েও অভ্যন্তরীণ সংকটের মাত্রা অনেক বেশি। দেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। মুডি’স-এসঅ্যান্ডপির মতো ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে দেশের ঋণমানকে নেতিবাচক করে দিচ্ছে। এগুলো অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যয় ডেকে আনবে।’

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পূর্বাভাসকে স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচকে নামিয়ে এনেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা ফিচ রেটিংস। তবে ঋণমানের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রায় দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা বা লং টার্ম ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) ‘‌বিবি মাইনাসে’ বহাল রেখেছে সংস্থাটি। 

অর্থনৈতিক পূর্বাভাস স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচকে আনার বড় কারণ হিসেবে ফিচের গতকাল প্রকাশিত প্রতিবেদনে রিজার্ভের পতন ও ডলার সংকটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে নেয়া নীতিগত পদক্ষেপ এবং বিদেশী আনুষ্ঠানিক ঋণদাতাদের ক্রমাগত সহায়তাও রিজার্ভের পতন ও স্থানীয় বাজারে ডলার সংকট প্রশমন করতে পারেনি। 

ফিচের ভাষ্যমতে, অর্থনীতিতে দেশের বাইরে ঘটা ঘটনাবলির অভিঘাত প্রশমনের মতো উপাদান (বাফার) কমে এসেছে। এসব বাফার দুর্বল হয়ে পড়ায় অর্থনীতিতে বহিঃস্থ অভিঘাত মোকাবেলায় বেশ নাজুক অবস্থানে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ প্রোফাইল এখনো নিয়ন্ত্রণযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাও এখনো অনুকূলে। আবার সরকারের ঋণ সমতুল্য অনেক দেশের তুলনায় বেশ কম। এ কারণে ঋণমান এখনো বিবি মাইনাসে বহাল রাখা হয়েছে। যদিও এসব ইতিবাচক বিষয়ের বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আহরণ ও মাথাপিছু আয় কম হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্বলতা এবং সুশাসনের সূচকগুলোর ঘাটতির মতো বিষয়গুলোরও মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। 

এর আগে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বা ঋণমান কমিয়েছিল আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান মুডি’স ও এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। এর মধ্যে সর্বশেষ গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ নিয়ে মূল্যায়ন প্রকাশ করেছিল এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। সংস্থাটির মূল্যায়নেও দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং ‘বিবি মাইনাস’ নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওই সময় এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিদেশী ঋণ ও তারল্য পরিস্থিতি আরো প্রতিকূলে গেলে এ ঋণমান আরো কমে যাবে। এছাড়া আগামী বছর দেশের ডলার পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আরো চাপের মুখে পড়তে পারে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। 

বিশ্বব্যাপী মুডি’স, এসঅ্যান্ডপি ও ফিচ রেটিংস—মার্কিন এ তিন প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ঋণমানের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। বৈশ্বিক ক্রেডিট রেটিং বাজারের সিংহভাগই প্রতিষ্ঠান তিনটির নিয়ন্ত্রণে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যে এ তিন প্রতিষ্ঠানের দেয়া ঋণমান ও অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের প্রভাব পড়ে। 

চলতি বছরের ৩১ মে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়ে দেয় মুডি’স। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন বড় দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যেও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। 

মুডি’স ও এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল ঋণমান অবনমন করে দেয়ার পর থেকে দেশের আমদানি-রফতানি তথা বৈদেশিক বাণিজ্যের শর্তগুলো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে বাড়তি ফি ও শর্তের মুখে পড়তে হচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলোকে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের সুদও বাড়তে শুরু করেছে। এ ধরনের ঋণের মেয়াদ কমে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন শর্ত আরোপ হচ্ছে। বিশ্বের সুপরিচিত বৃহৎ ব্যাংকগুলোও বাংলাদেশী ব্যাংকের জন্য ক্রেডিট লাইন বা ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে। 

ফিচের সর্বশেষ মূল্যায়নে বাংলাদেশের ঋণমান বিবি মাইনাসে বহাল রাখা হলেও অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদ তেমন একটা প্রকাশ পায়নি। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর চাপ সামনের দিনগুলোয় আরো অব্যাহত থাকবে। আমদানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতির কারণে মোট রিজার্ভ (গ্রস) নেমে এসেছে ২৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফের বিপিএম৬ মান অনুসরণ করে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্টের জন্য বরাদ্দ বাদ দিলে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৫ বিলিয়নে। বিপিএম৬ পদ্ধতিতে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বছরের শেষে রিজার্ভের পরিমাণ থাকবে তিন মাসের বৈদেশিক লেনদেন পরিচালনার মতো।  

২০২৫ সালের মধ্যে দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি আরো বড় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে ফিচ রেটিংসের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও আমদানিতে বিধিনিষেধ শিথিলের মধ্যে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি এখন বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। একাধিক হারের মধ্যে একক বিনিময় হার পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত না। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন বিনিময় হারে নমনীয় নীতিমালা গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুন শেষে আইএমএফ রিজার্ভের যে লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিল, তা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। 

ফিচের ভাষ্য অনুযায়ী, সরকারের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতও বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত গড়ের তুলনায় অনেক কম। আইএমএফ বাংলাদেশকে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। সংস্থাটির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষে সরকারের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হতে হবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শেষে তা দাঁড়াতে পারে ১০ দশমিক ৩ শতাংশে। যদিও এ প্রক্ষেপণে উঠে আসা লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে কর অব্যাহতি, ফাঁকি ও দুর্বল কর ব্যবস্থাপনা। আবার জুন শেষে আইএমএফ নির্ধারিত রাজস্বের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্য রাখা হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ, যা ২০২২-২৩-এ করা হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। (সুত্র : বণিক বার্তা)