দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রেকর্ড খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, সরকারের ধারের প্রবণতা বৃদ্ধিসহ নানামুখী সংকট নিয়ে ঘটনাবহুল ২০২৩ সাল পার করছে বাংলাদেশ। এসব সংকট আগামী ২০২৪ সালেও রয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশি ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। অর্থনীতির চলমান সংকট ও তা মোকাবিলার কৌশল নিয়ে দেশ রূপান্তরকে এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
প্রশ্ন: দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের বাজারে ডলারের যে সংকট চলছে তার নেপথ্য প্রধান কারণ কী?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: একটি দেশ বিদেশি মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সংকটে তখনই পড়ে যখন মুদ্রাটির চাহিদা ও জোগানে মিসম্যাচ তৈরি হয়। আমাদের দেশে ডলারের যে সরবরাহ আসে সেটা মূলত রপ্তানি, প্রবাসী আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিদেশি ঋণ থেকে। এগুলো আমাদের সরবরাহের জায়গা। আর চাহিদার দিকটা হলো আমাদের আমদানি, বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রায় আমাদের যে পেমেন্ট করতে হয়, ঋণ পরিশোধ করতে হয় ইত্যাদি। এখন আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক যে চাপ সেটির কারণে দেখা যাচ্ছে যে, গত দেড় বছর ধরে চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে একটি ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। এটির প্রথম কারণ ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে যখন হঠাৎ করে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে তখন আমাদের বাণিজ্য ভারসাম্য অনেক বেশি নেতিবাচক হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, সেটিকে আমরা কিছুটা সামাল দিলেও আর্থিক খাতে যে ভারসাম্যটা ছিল সেটির মধ্যে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এটি আগে ইতিবাচক ছিল। সেখানে যে বিদেশি মুদ্রা আসত, সেটি আমরা বিভিন্ন ক্রেডিটের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারতাম। কিন্তু সেখানে যে লেনদেন সেটি এখন ইতিবাচক থেকে ঋণাত্মকের ঘরে চলে গেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমাদের চাহিদা এবং জোগানের যে ভারসাম্যের মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায় সেখানে জোগান তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।
এর ফলে আমরা চাহিদা সংকোচন করছি এবং আমদানি সাত বিলিয়ন ডলার থেকে সাড়ে পাঁচ বিলিয়নের মধ্যে নামিয়ে নিয়ে আসছি। কিন্তু সেটিও আমরা সামাল দিতে পারছি না। এখন আমাদের রপ্তানি, প্রবাসী আয় বাড়িয়ে এটি সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার অনেকদিন ধরে রাখার ফলে চাহিদা জোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এখন টাকার অবমূল্যায়ন করেছি অনেকটুকু, কিন্তু সেটিও যথেষ্ট পরিমাণে আমরা করিনি। যদি আরও অবমূল্যায়ন করি তবে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা কিছুটা কমিয়ে এনে একটা স্থিতিশীলতায় আনতে পারব। ইতিমধ্যে কিছুটা দরপতন হয়েছে। এর ফলে আমদানি সংকোচনের একটা অভিঘাত পড়েছে। প্রভাব পড়েছে আমদানি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। সামষ্টিক অর্থনীতিকেও একটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমি বলব সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সঠিক সময়ে টাকার বিনিময় হারের অবনমন না করার ফলে এ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি।
প্রশ্ন: ডলার সংকট উত্তরণের করণীয় কী হবে?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। টাকার অবমূল্যায়ন যতটুকু হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার যে নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে সেটি আরও অব্যাহত রাখতে হবে। দরপতনের ধারা আরও বজায় রাখতে হবে। এটার একটি কস্ট (ব্যয়) আছে, আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতিকে রাজস্ব নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সেটি কিছুটা সামাল দিতে হবে। সেটি অবশ্যই মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির সমন্বয় করে। এখন বিদেশি মুদ্রার মানকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার নীতিকে আরও সামনের দিকে নিতে হবে। এটার প্রভাব অবশ্যই আমাদের অর্থনীতিতে পড়বে। এটিকে মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সমন্বয় করছে, আরও সমন্বয়ের দরকার হবে। এটি আমদানিকেও আরেকটু সংকুচিত করতে সাহায্য করবে। টাকার অবমূল্যায়ন আরও করা হলে রেমিট্যান্সের ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ডলারের দামের পার্থক্যের কারণে কিছু টাকা ইনফরমাল (অপ্রাতিষ্ঠানিক) চ্যানেলে চলে গেছে, তা যদি প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমে আনা যায় তাহলে সরকারের এবং ব্যাংকিং খাতের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সেটিও আর লাগবে না। রপ্তানি সক্ষমতা বাড়বে। সুতরাং নতুন একটি ভারসাম্যে যেতে হবে। এটিতে পেইন আছে। কিন্তু সেটি বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করলে আরেকটি নতুন ভারসাম্যে পৌঁছাবে।
প্রশ্ন: ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট প্রকট, নতুন বছরে এই সমস্যা অব্যাহত থাকলে কী হতে পারে?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: তারল্য সংকট অব্যাহত থাকলে তো অবশ্যই অর্থনীতির ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বাড়বে। অর্থনীতির ঝুঁকি এড়াতে সুদ ও বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোকে যৌক্তিক পরিণতির কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। যদিও টাকার মূল্যমান বাজারের চাহিদা জোগানের সঙ্গে সমন্বয় করাসহ বেশ কিছু সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদের হারকেও বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। কিছুটা বাংলাদেশ ব্যাংক করছে। কিন্তু এটি আরও বাজারমুখী করতে হবে। তাহলে সঞ্চয় বাড়বে। ইতিমধ্যে আমরা দেখছি যে, সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার বাড়ার ফলে ব্যাংকিং খাতে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে এটিকে অব্যাহত রাখতে হবে। তবে এর অন্য দিক হলো- ঋণের সুদহার বাড়বে এবং বিনিয়োগের ওপরে তার একটা প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগকারীদের অন্যান্য যেসব খরচ আছে তারমধ্যে সুদের হার কেবল একটা উপাদান। কস্ট অব ডুয়িং বিজনেসসহ ব্যবসার খরচের অন্য যেসব উপাদান আছে, চেষ্টা করতে হবে সেগুলোকে কীভাবে কমানো যায়। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, বিলম্ব হওয়া এগুলোকে চিহ্নিত করে অন্যান্য আরও কিছু খরচ আছে সেগুলো কীভাবে কমানো যায় তা ভাবতে হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তারল্য সংকোচনের যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা সঠিকভাবে কাজ করছে কি না?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: তারল্য সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে। সরকারকে দেওয়া এই বড় ঋণের নেতিবাচক পরিণতির কারণে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে সুদের হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার মাধ্যমে চাহিদা এবং জোগানের নতুন ভারসাম্য সেখানে আনতে হবে। একই সঙ্গে সেটিকে সঞ্চয়ের মধ্যে অব্যাহত রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনার বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে অব্যাহত রাখতে হবে এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ঋণ পেতে কোনো অসুবিধার সম্মুখীন যাতে না হয় সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। বাজারের সঙ্গে সুদের হার সমন্বয় করলে অবশ্যই ঋণ নেওয়ার খরচ হার বাড়বে। আমি বলব ক্ষুদ্র, মাঝারি যারা আছে তাদের যে স্কিমগুলো আছে সেগুলো চালু রাখতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যে সহায়তা রয়েছে তা সমান্তরাল রাখতে হবে।
প্রশ্ন:বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে সুদের হার বাড়ছে, এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দেবে কি না?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। একদিকে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ব্যবসার খরচ বাড়বে। অন্যদিকে ঋণও কিছুটা সংকুচিত করবে। মূল্যস্ফীতির আরেকটা বড় কারণ টাকার মান কমে যাওয়া। তবে এসব কারণেই যে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তা নয়। আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর, উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তরের যে সরবরাহ চেইনে প্লেয়াররা কাজ করেন তারাও নিজেদের ক্ষমতাবলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে দেন। নজরদারি, খবরদারি, প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আইনের প্রয়োগ, প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রম শক্তিশালী করা, ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যক্রম শক্তিশালী করার পাশাপাশি যারা এসবের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সেসব মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা সামলে নিতে পারব আমরা। মূল্যস্ফীতির কারণে জনসাধারণ বিশেষত স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর জন্য আমাদের সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে কাজ করার আওতা আরও বাড়াতে হবে।
চাপটা কিছুটা আমরা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারব। চলমান যে নীতি ভারসাম্য তা স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপরে এটা একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছেই সেটা তো সামাল দেওয়ার জন্য সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোকে আরও শক্তিশালী করারও প্রয়োজন পড়বে। চলমান যে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপরে সেটি বিভিন্ন রাজস্বনীতি এবং সরকারি সহায়তানীতি, সামাজিক সুরক্ষানীতি এগুলো দিয়ে সামাল দিতে হবে।
প্রশ্ন: একদিকে সংকোচনমূলক নীতি অন্যদিকে ব্যাংকগুলোকে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার মাঝখানে কয়েকদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়নি, এখন আবার সংকটে ঋণ নেওয়া শুরু করেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ব্যাহত হবে কি না?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: কিছুটা তো সেটির ওপর প্রভাব পড়বেই। মাঝখানে কিছুটা কমিয়েছে, এটা এখন আবার ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। তবে যতটা সম্ভব চেষ্টা করতে হবে ব্যাংকের যে ঋণ মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে সেটাকে যতটুকু সংযত রাখা যায়। বরং সুদের হার বাড়ালে সঞ্চয়ের ওপর যে ইতিবাচক প্রভাবটা পড়বে ব্যাংকের যে তারল্য প্রবাহটা আসবে সেই বাজার সমন্বয় নীতি অব্যাহত রেখে সামাল দিতে হবে।
প্রশ্ন: সরকারের ঋণপ্রাপ্তি কমে গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে অর্থছাড়ও করতে পারছে না। এটি কীভাবে দেখছেন?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি এটা আমাদের বৈদেশিক ঋণ হোক বা অভ্যন্তরীণ ঋণ হোক, তা তো আমাদের অনেক দিনেরই সমস্যা এবং এই সমস্যা বছরের পর বছর চলছে। তবে এই সময়ে দ্রুত বাস্তবায়ন, সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে এবং এটা যাতে সুশাসনের সঙ্গে সাশ্রয়ী হয়। আমাদের কিন্তু বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার চাপের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। এই সময়ে সরকারি ব্যয়, প্রকল্প ব্যয় এগুলোর কিছুটা শর্ত সংকোচন করার নীতি সরকার নিয়েছে, আমার মনে হয় সেটি ঠিক আছে। যে প্রকল্পগুলো শেষ করার কথা সেগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে এবং প্রকল্পের খরচ যাতে না বাড়ে সেটাও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। পাইপলাইনে যেসব বিদেশি ঋণ আছে সেগুলো দ্রুত ছাড় করতে পারলে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস ও বৈদেশিক যে ভারসাম্য তাতে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ইতিবাচক একটি প্রভাব পড়বে। পাইপলাইনের প্রকল্পগুলো যাতে আমরা দ্রুত টাকা ছাড় করতে পারি, বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ওপর সর্বসাকুল্যে মোট ব্যালেন্সের ওপরই এর প্রভাবটা পড়বে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের দায়ভার কিন্তু খুব দ্রুতহারে বাড়ছে সেখান থেকে নিজস্ব রাজস্ব আহরণ কীভাবে বাড়াতে পারি এবং সেটার উদ্বৃত্ত দিয়ে কীভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির একটা অংশ বাস্তবায়ন করতে পারি সেদিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
প্রশ্ন: নতুন বছরে অর্থনীতির জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হবে?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: নতুন বছরে চ্যালেঞ্জ অনেকগুলো। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা। মনে রাখতে হবে মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যে উচ্চস্তরে চলে আসছে। সুতরাং মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমালেও মূল্য স্তর কিন্তু ওপরের দিকে থাকবে। সুতরাং সেখানে সাধারণ মানুষের সামাজিক অবস্থান তাদের স্বস্তি দেওয়ার একটি বড় চ্যালেঞ্জ আমার মনে হয় থাকবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন সঠিক সময়ে দক্ষতার সঙ্গে করার চ্যালেঞ্জটাও থাকবে। বিনিময় হার, সুদের হার সেগুলোকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা, সেগুলো থেকে ইতিবাচক ফলাফলগুলোকে নিশ্চিত করা, নেতিবাচক দিকগুলোকে সামাল দেওয়া এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে নতুন একটি ভারসাম্যের দিকে নিয়ে যাওয়াই হবে অন্যতম করণীয়। সেটি হবে বড় চ্যালেঞ্জ। এটি করতে যেসব প্রতিষ্ঠান নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত, প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত সেগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে তার মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। যাতে করে মূল্যস্ফীতিটা কমিয়ে ভারসাম্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার ব্যালেন্স বাড়াতে পারি। এক কথায় সামষ্টিক অর্থনীতির যে ব্যবস্থাপনা আছে সেটার দক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও উৎকর্ষতার দিকেও নজর দিতে হবে। সর্বস্তরের সুশাসন এবং সরকারি সেবা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা বাড়াতে হবে।
প্রশ্ন:আইএমএফের যেসব সংস্কার প্রস্তাব ছিল সেগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: এখন আইএমএফের পরামর্শ ও শর্ত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন নিয়মনীতি প্রণয়ন করা, সেগুলো ডাইরেক্ট ট্যাক্স অ্যাক্ট, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাক্ট এবং ব্যাংকিং অ্যাক্টগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সুদের হার এবং বিনিময় হারকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার যে পদক্ষেপ সেটিকে এখন আরও দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে আইএমএফ পরামর্শ দিচ্ছে বলেই নয়, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এটা করতে হবে। আমরা যদি নিজেরা নিজেদের মনে না করি যেমন, ব্যাংকিং আইন আমরা পাস করলাম। ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে খুব ভালো কিন্তু এগুলো যদি আইএমএফের পরামর্শ হিসেবে নিই, নিজেরা যদি ব্যাপারটাকে নিজেদের স্বত্ব হিসেবে মনে না করি তাহলে বাস্তবায়নে দুর্বলতা থেকেই যাবে। কেবল আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, সেটি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সেদিকটাতে মনে হচ্ছে বেশি নজর দিতে হবে। আইএমএফের শর্ত তো আছেই, সেটি আমাদের কিস্তি পাওয়ার জন্য দরকার। অন্যান্য যেসব বিদেশি আছেন তাদেরও যাতে আস্থা আমাদের ওপর থাকে। আমাদের ঋণ যেগুলো পাওয়ার কথা সেগুলো যাতে আমরা পাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা নিজেরা যাতে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করি এবং বাস্তবায়ন করি। কারণ শুধু পরামর্শ হিসেবে নিলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা থেকে যায়। অতীতেও আমরা দেখেছি যে কাজটি করতে চাই সেটি আর করা হয় না। সেদিক থেকে আমাদের নিজেদের অর্থনীতি যে একটা ঝুঁকির দিকে আছে সেটিকে স্বীকার করে যেসব পদক্ষেপ সেসব বাস্তবায়নের জন্য আমাদের জোর অগ্রাধিকার দিতে হবে।
প্রশ্ন: অনেকেই আশঙ্কা করছেন দেশের অর্থনীতি আরও প্রকট আকার ধারণ করবে, আপনার গবেষণা কী বলে?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমরা যদি ঠিকভাবে পদক্ষেপ নিই, বিশেষ করে অনেক পদক্ষেপই সঠিকভাবে নিচ্ছি। চেষ্টা করতে হবে সেগুলো যাতে আমরা আরও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারি। সেগুলো করলে এক ধরনের ফলাফল হবে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সেসব জায়গায় হাত দিতে হবে, যেমন রাজস্ব কীভাবে বাড়াতে পারি, বিশেষত ডাইরেক্ট ট্যাক্সেশনের মাধ্যমে। দুর্নীতিগুলো কীভাবে কমাতে পারি, ব্যাংকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি যারা করেছে তাদের কীভাবে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারি, দুর্নীতি দমন কমিশনকে কীভাবে আরও শক্তিশালীভাবে কাজ করতে দিতে পারি, দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করছে তাদের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোধ করতে পারি। এগুলো যদি ঠিকভাবে করতে পারি তাহলে একভাবে ফল হবে, আর যদি মনে করি সবই তো ভালোই চলছে তাহলে ফল হবে আরেক ধরনের।
সুত্র : সিপিডি