বাজেটে একদিকে যেমন থাকবে আয়-ব্যয়ের হিসাব, অন্যদিকে থাকবে সময়ের লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন– এমনটিই আশা করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে এমন সময়ে যখন জাতির সামনে রয়েছে সাম্প্রতিক অর্জন ও সাফল্যের ধারা বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক লেনদেনে বিশাল ঘাটতি আর তার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত ক্ষয়, রেমিট্যান্স প্রবাহে অস্থিতিশীলতা, দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হারে অবনতি ও মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতিতে বড় উল্লম্ফন– সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি প্রায় এক বছর ধরেই বড় চাপের মুখে। মূল্যস্ফীতিতে উল্লম্ফনের ফলে শুধু দরিদ্র নন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাও হয়ে উঠেছে কঠিন।
সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর চাপ সামাল দিতে গিয়ে নেওয়া হয়েছে আইএমএফ থেকে ঋণ– যার সঙ্গে এসেছে একগাদা শর্ত। ফলে নীতিকৌশল প্রণয়নে সৃষ্টি হয়েছে বাড়তি বাধ্যকতা। এরকম অবস্থায় বাজেট প্রণয়ন সহজ কাজ ছিল তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বহুধা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যে ধরনের চিন্তা এবং বিবেচনা প্রয়োজন ছিল তা এই গতানুগতিক ধারার বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি ।
যে বাজেট জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়েছে তাতে আয়-ব্যয়ের হিসাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ঘাটতির পরিমাণ এবং তা পূরণের পন্থার বিবরণ। সঙ্গে দেওয়া হয়েছে অভীষ্ট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার (৭.৫%) এবং মূল্যস্ফীতির হার (৬%)। অর্থনীতির বাস্তব অবস্থা এবং চ্যালঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য যা করতে হবে সেসব বিবেচনায় নিলে এই দুটি লক্ষ্যই অবাস্তব বলে মনে হয় । উদাহরণস্বরূপ, সুদের নির্দিষ্ট হারের বদলে বাজার নির্ধারিত হার চালু হলে এবং মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে ঋণ, আমদানি, বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা কি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে? তেমনি এসব পদক্ষেপের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি কতটা কমতে পারে (না কি আরও বাড়তে পারে– বিশেষ করে বিনিময় হারের আরও অবনতি হলে আর তার ফলে আমদানি ব্যয় বাড়লে) তা কি ভাবা হয়েছে?
আসলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার জন্য যে ধরনের নীতিকৌশলের প্রয়োজন হবে তার সঙ্গে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির কিছুটা হলেও বিরোধ হতে পারে। এরকম অবস্থায় প্রয়োজন ছিল এমন একটি বাজেট, যার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যাবে এবং একই সঙ্গে দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবন ও জীবিকার জন্য সুরক্ষা-সহায়তা দেওয়া হবে। অন্য কথায় মানবিক পন্থায় স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধার। কিন্তু বর্তমান বাজেট সেই পথে না গিয়ে গতানুগতিক পথেই হেঁটেছে।
এই গতানুগতিক পথ এতই প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক যে সেখানে কর্মসংস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরও স্থান অতিনগণ্য। এ বিষয়ে যে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে তাতে শুধু বলা হয়েছে আমরা টেকসই কর্মসংস্থানের জন্য সহায়ক কর্মসূচি গ্রহণ করছি। কিন্তু কী সেসব কর্মসূচি তা কিছুই বলা হয়নি। অন্যান্য খাত সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে রপ্তানি বহুমুখীকরণের মতো পুরোনো কথাই আবার বলা হয়েছে– যদিও সে লক্ষ্যে কী কর্মকৌশল বা নীতিমালা গ্রহণ করা হচ্ছে তা বলা হয়নি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব খাতে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি সেসব খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমেছে এবং সার্বিকভাবে শিল্প খাতে নিয়োজিতের সংখ্যাও কমেছে। অন্যদিকে কৃষিতে নিয়োজিতের সংখ্যা বেড়েছে এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান কমার কোনো ধারা সৃষ্টি হয়নি। বর্তমান বাজেটসহ সাম্প্রতিক সময়ের কোনো বাজেট বা অন্য কোনো কর্মকৌশলে উৎপাদনশীল এবং শোভন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। শ্রমবাজারের বিপরীতমুখী প্রবণতাকে কীভাবে রোধ করা যায় তা আদৌ ভাবা হয়েছে কি? কী ধরনের প্রণোদনা দিলে তৈরি পোশাকের মতো আরও কয়েকটি শ্রমনিবিড় শিল্প গড়ে উঠতে পারত তা বাজেট প্রণয়নে বিবেচনায় এসেছে বলে মনে হয় না।
উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে যেখানে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার শ্রমশক্তি বৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে না, সেখানে সরকার অনেক সময় সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের কিছু কর্মসূচি চালু থাকলেও তাদের পরিসর অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে মনে হয় না। খাদ্য অথবা অর্থ মজুরির বিনিময়ে কর্মসূচিগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ অনেক দিন ধরেই স্থবির। অথচ অর্থনীতিতে নিম্নগতি অথবা সংকটের সময় এ ধরনের কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে দরিদ্রদের কিছুটা হলেও সহায়তা দেওয়া যেতে পারত। বাজেট প্রণয়নে এ ধরনের কোনো ভাবনা ছিল বলে মনে হয় না– যদিও বিদ্যমান কর্মসূচিগুলোতে দৈনিক মজুরি ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির হার বেশ ভালো হলেও তা এখনও কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরির চাইতেও কম রয়ে গেছে। এটি শোভন কাজ সৃষ্টির লক্ষ্যের পরিপন্থি।
অন্যদিকে শ্রমবাজারে সার্বিকভাবে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না বলে প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। যদিও খাতভিত্তিক মজুরি হালনাগাদ করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রয়েছে। সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে সে ব্যবস্থা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ, প্রাক্তন বিশেষ উপদেষ্টা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, জেনেভা