স্বাধীনতার পর থেকে নানামুখী সংকটের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দেশের বীমা খাত। তবে এ খাতে মানুষের আস্থার জায়গাটি এখনো তৈরি করতে পারেনি বীমা কোম্পানিগুলো। সার্বিকভাবে খাতটির প্রতি মানুষের অনাস্থার জায়গাটা প্রকাশ পেয়েছে। সরকার এ খাতের উন্নয়নের জন্য জাতীয় বীমা দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া এ খাতের প্রচারণার অংশ হিসেবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বীমা মেলা ইত্যাদি চালু করেছিল। তার পরও বীমা খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে গ্রাহকের বীমা দাবি দ্রুত পূরণ করার ক্ষেত্রে। বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে সময়মতো প্রিমিয়াম নিলেও মেয়াদ শেষে সঠিক সময় বীমা দাবি পরিশোধ করে না—এমন অভিযোগ আসছে অনেক দিন থেকে। তবে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত জীবন বীমার দাবিগুলো যথাসময়ে পূরণের স্বস্তির খবর এসেছিল। কিন্তু আবারো দেশের জীবন বীমা খাতের বিরাট অংশের দাবি যথাযথ পরিশোধ করছে না দেশে ব্যবসা করা জীবন বীমা কোম্পানিগুলো। গত তিন বছরে দেশে জীবন বীমার দাবি পরিশোধের হার ক্রমাগত কমছে। ২০১৮ সালে যেখানে বীমা দাবি অনিষ্পন্নের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর পর থেকে বীমা দাবি অনিষ্পন্নের হার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চলেছে। ২০২২ সালে এ হার দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশে। আর টাকার হিসাবে গত বছর অনিষ্পন্ন বীমা দাবির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা।
সাধারণত আমাদের দেশে দুই ধরনের বীমা হয়ে থাকে। একটি হলো জীবন বীমা, অন্যটি সাধারণ বীমা। এর মধ্যে জীবন বীমা সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবনের ঝুঁকি গ্রহণের মাধ্যমে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। এ ধরনের বীমায় একজন ব্যক্তি নিজের বা পরিবারের কোনো সদস্যের জীবন বীমা করাতে পারেন। বীমাকারী ব্যক্তির মৃত্যুর পর পরিবার বা মনোনীত ব্যক্তিকে বীমাকৃত অর্থের পুরোটাই প্রদানের বিধান আছে। অন্যদিকে, বাড়ি গাড়িসহ নানা সম্পদের সুরক্ষায় করা হয়ে থাকে সাধারণ বীমা। বিশেষ করে আগুন, চুরি, বন্যা, ঝড়, দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্ঘটনা থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র রক্ষার বীমা চুক্তি সম্পাদন হয়। বীমা শিল্পটি মূলত প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারনির্ভর একটি খাত। কিন্তু আমাদের দেশের জীবন বীমা খাতে সময়মতো গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ না করার উদাহরণ বীমা খাতকে আবারো নেতিবাচকভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্য মতে, ২০০৯ সালে বীমা দাবি পরিশোধের হার ছিল ৭১ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর পরের বছরগুলোয় বীমা দাবি পরিশোধের হার ক্রমে বাড়ছিল। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ বীমা দাবি ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ পরিশোধ করা হয়। এরপর ক্রমাগত কমতে শুরু করেছে বীমা দাবি পরিশোধ। ২০১৯ সালে তা দশমিক ৫১ শতাংশ কমে ৮৮ দশমিক ৮৮ শতাংশে দাঁড়ায়। পরবর্তী বছরও আরো কমে ৮৪ দশমিক ৮২ শতাংশ, ২০২১ সালে এসে তা ৭০ দশমিক ৪০ শতাংশে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২২ সালে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বীমা খাত একটি দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বড় ভূমিকা রাখে। আর বাংলাদেশের মতো দেশে বীমার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু গত এক দশকে যখন অর্থনীতি বড় হচ্ছে, তখন বীমা খাত যেন ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় যখন মানুষ বীমা ছাড়া তাদের জীবন ভাবতেই পারে না, সেখানে গত ১০ বছরে জীবন বীমা খাতের প্রসার আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আমাদের দেশে নানা অনিয়মে জড়িত থাকার কারণে দেশে ব্যবসা করা বেশ কয়েকটি জীবন বীমা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে তারা গ্রাহকদের বীমা দাবি সঠিকভাবে পরিশোধ করতে পারছে না। বীমা খাতে ইতিবাচক ইমেজ ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের উচ্চমহল থেকে নির্দেশনা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ প্রায় এক ডজন বীমা কোম্পানির ব্যবসা সাময়িক বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে খবর এসেছে। আইডিআরএ এরই মধ্যে জানিয়েছে, কয়েকটি কোম্পানির অবস্থা খুবই খারাপ। এগুলো ভালো করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সামনের কয়েক বছরের মধ্যে কোম্পানিগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানি সক্ষমতা না থাকায় গ্রাহকের দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। সার্বিক দিক বিবেচনায় কয়েকটি কোম্পানির ব্যবসা সাময়িক বন্ধের পরিকল্পনা ইতিবাচক মনে হলেও আমাদের বীমা খাত ও বীমা গ্রাহকদের কথা ভাবা দরকার। বীমা কোম্পানিগুলোর তহবিল সংকট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জীবন বীমা খাতের দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অধিকাংশ পলিসি তামাদি হয়ে যায়। ১০০টি পলিসি গ্রহণ করা হলে তার মধ্যে মাত্র ৪০টি পলিসি টিকে থাকে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল গঠন করতে পারে না। এর ওপর প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও অনেক বেশি। যথাযথভাবে তহবিল গঠন করতে না পারার কারণে তাদের গ্রাহকের অর্থ যথাসময়ে পরিশোধের কোনো সুযোগ থাকে না।
এদিকে বীমা কোম্পানির বক্তব্য, আগের চেয়ে ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন অনেক কমে গেছে, বীমা দাবি অপরিশোধিত থাকার পেছনে এটি একটি বড় কারণ। পাশাপাশি বীমা পলিসিতে থাকা গ্রাহকের নাম ন্যাশনাল আইডি কার্ডের সঙ্গে না মেলায় দাবি পরিশোধের সময় সমস্যা দেখা দেয়। অনেক গ্রাহক যখন বীমা করেছেন তখন তাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড ছিল না। পরবর্তী সময়ে তাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড এসেছে। কোনো দাবি উত্থাপিত হলে বীমা কোম্পানি গ্রাহকের কাছে ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়ে মিলিয়ে দেখে থাকে। কিন্তু প্রায়ই সময় দেখা যায়, গ্রাহকের জমা দেয়া ন্যাশনাল আইডি কার্ডে থাকা নামের সঙ্গে বীমা পলিসির নামের মিল পাওয়া যায় না, যার ফলে দাবি পরিশোধে সমস্যা হয়। তবে কেউ এফিডেভিট করে দিলে বীমা কোম্পানিগুলো দাবির অর্থ পরিশোধ করে থাকে।
ক্ষমতা বিবেচনায়ও দেশের অন্যান্য খাতের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে বীমা খাত। এ খাতে দক্ষ জনবল নেই, প্রয়োজনীয় এবং হালনাগাদ আইন নেই। সরকারের প্রয়োজনীয় নজরদারিও নেই। ফলে এ খাতে চলছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা। জীবন বীমাসহ সাধারণ বীমার ক্ষেত্রেও নানা অজুহাতে গ্রাহকের পাওনা টাকা না দিয়ে বেশির ভাগ কোম্পানি হয়রানি করছে গ্রাহকদের। কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে এমন শত শত অভিযোগ জমা আছে। এসব কোম্পানির মালিকরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় আইডিআরএর পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। এ কারণে ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়ে আদালতের কাছেও যাচ্ছেন। এতে অনেকে দীর্ঘসূত্রতার ফাঁদে আটকে পড়ে যাচ্ছেন। বীমা কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিগুলোকে আগে কন্ট্রোলার অব ইন্স্যুরেন্স দেখাশোনা করত। আইডিআরএ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নিজস্ব অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। বীমা খাতে অনিয়মগুলো রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এ খাতের ভাবমূর্তিকে ইতিবাচক করতে হলে বীমা কোম্পানিগুলোকেও নিজেদের তহবিল গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সময়মতো গ্রাহকের দাবি পূরণের বিষয় আরো উদ্যোগী হতে হবে। বীমা খাতের অবনতিকে কমাতে হলে সরকারকেও এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে হয়তো প্রকৃত সমাধান আসবে আমাদের বীমা খাতে।