ড. এটিএম তারিকুজ্জামান ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে এমকম এবং সাউথ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি (ইউকে ক্যাম্পাস) থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকারি এ চাকরির পাশাপাশি সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি এবং এশিয়া-প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি পরিবারসহ ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে মাস্টার অব ফিনান্সিয়াল প্ল্যানিং (এমএফপি) ও মাস্টার্স অব প্রফেশনাল অ্যাকাউন্টিং (এমপিএ) অধ্যয়নের জন্য স্কলারশিপ লাভ করেছিলেন।
পিএইচডি শেষে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের মোনাশ ইউনিভাসির্টির মোনাশ বিজনেস স্কুল, আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি এবং নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটনের স্কুল অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড কমার্শিয়াল ল'তে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে বিএসইতে কাজ শুরু করেন। গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তারিকুজ্জামানকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে অনুমোদন দেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর 2023 ডিএসইতে যোগদান করেন।
সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকে মুখোমুখি হলে উঠে আসে তার কথায় দেশের শেয়ারবাজার নিয়ে নানা পরিকল্পনা এখানে তার কিছু অংশ উপস্থাপন করা হলো
প্রশ্ন : পুঁজিাবাজারকে বিনিযোগ বান্ধব করতে আপনার পরিকল্পনা কি?
এটিএম তারিকুজ্জামান : একটি প্রাণবন্ত ও উন্নত পুঁজিবাজার গড়তে চাই। বর্তমান বাজারকে কীভাবে মানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মানের করা যায় সেই উদ্যোগ নেব। যাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেন মনে করে এখানে একটি ভালো মানসম্মত স্টক এক্সচেঞ্জ আছে।
প্রশ্ন: রেগুলেটর হিসেবে কাজ করছেন এতদিন, এখন রেগুলেটরের অধীনে কাজ করবেন, কতটুকু কমফোর্টেবল মনে হচ্ছে?
এটিএম তারিকুজ্জামান : পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জের কতগুলো কমন ইস্টারেস্ট আছে। সেটা হচ্ছে; পুঁজিবাজারকে ট্রান্সপারেন্ট করা, ফেয়ার করা এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং পুঁজিবাজারকে সুশৃঙ্খল করা। এটি কমিশন ও স্টক এক্সচেঞ্জের ম্যান্ডেট। সেদিক থেকে এটি আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবে এর বাইরে স্টক এক্সচেঞ্জের আরও কাজ রয়েছে। সেটির একটি হচ্ছে; স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানির বিজনেস ফোকাস করবে। এখানে যারা শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন তাদের স্বার্থ দেখতে লাগবে। আরেকটি, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পলিসির কাজে সহযোগিতা করা। কারণ বিএসইসি হলো সুপ্রিম অথরিটি। আর ডিএসই হলো, স্টক এক্সচেঞ্জের পলিসি মেকিংয়ের সঙ্গে জড়িত। ডিএসইর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে, বিএসইসিকে বলতে হয়। আমি যেহেতু কমিশনে কাজ করেছি, আমি তাদের কাজ ও ম্যান্ডেট জানি। আমি সেই জিনিসটা এখানে কমিউনিকেট করতে পারব সুন্দরভাবে।
প্রশ্ন: রেগুলেটর চেয়ে ডিএসইর বয়স বেশি তারপরও পুঁজিবাজার আস্থার জায়গায় যেতে পারছে না কেন, আপনি কী মনে করেন?
এটিএম তারিকুজ্জামান : আস্থার জায়গাটা হলো-‘সাইকোলজিক্যাল ট্রেন্ড অব মাইন্ড’। এই জায়গাটার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। এখানে যত বেশি সুশাসন থাকবে, তত বেশি আস্থা বাড়বে। এখন আমাদের পুঁজিবাজারে আস্থা বাড়ানোর জায়গা রয়েছে। সুশাসন আস্থা বাড়ানোর ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সুশাসনের উন্নতি হলেই আস্থা বাড়বে। সারা দুনিয়াতে একই নিয়ম। সুতরাং আমরা যত বেশি কাজ করতে পারব; তত বেশি আস্থা বাড়বে।
প্রশ্ন: এখন পুঁজিবাজারে কী সমস্যা দেখছেন?
এটিএম তারিকুজ্জামান : পুঁজিবাজারের করপোরেট গভর্ন্যান্স, মার্কেটে গভর্ন্যান্সের অভাব রয়েছে। এগুলো দূর করতে বিনিয়োগকারীদের সচেতন হওয়া খুবই প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি স্টেকহোল্ডার এবং যারা পুঁজিবাজার ইন্টার্মেডিয়ারিজ, যেমন- ব্রোকার, কোম্পানির কর্মকর্তা, ম্যানেজমেন্টে রয়েছে তাদেরও সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির প্রোগ্রাম খুব বেশি করা হবে।
প্রশ্ন: বড় গ্রুপের ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে কম আসছে। এসব কোম্পানিকে বাজারে আনার জন্য কী কী উদ্যোগ নেবেন?
এটিএম তারিকুজ্জামান : ডিএসইর ব্যবসা বাড়াতে কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হবে। এ জন্য আমি খুবই এক্সাইটেড। রাষ্ট্রায়ত্ত, বহুজাতিক এবং দেশের বড় বড় গ্রুপের যেসব ভালো ভালো কোম্পানি আছে তাদের বুঝাতে হবে; পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানির ব্র্যান্ডিং হবে। কোম্পানির দাম ও মান বাড়বে। দীর্ঘ মেয়াদে বিনা সুদে ঋণ নিতে পারবে। আমরা সচেতনতামূলক প্রোগ্রামের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছাব। সবাইকে সুবিধাগুলো বুঝাব আশা করছি, তারা বাজারে আসবে।
প্রশ্ন: বেশ কিছু ব্রোকারেজ হাউজের মালিক বিনিয়োগকারীদের টাকা নিয়ে গেছে, এখনো ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। কাজেই ব্রোকার হাউজের মধ্যে সুশাসন নিশ্চিত করতে আপনি কি উদ্যোগ নেবেন?
এটিএম তারিকুজ্জামান : ব্রোকার ডিলার বা ট্রেকহোল্ডারের (ব্রোকারেজ হাউজের মালিক) জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। অথরাইজ রি-প্রেজেন্টেটিভরাই হচ্ছেন প্রধান। তাদের ট্রেনিং দিয়ে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এই জায়গাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তাদের মডিউল ও অ্যাসেসমেন্ট প্রক্রিয়া দেখতে লাগবে। তাহলে কোয়ালিটি ইম্প্রুভ হবে। তারা বুঝবে কোনটা ভালো কোনটা খারাপ। হ্যা, যেটা ম্যানুপোশেলন এটা অন্যায়, যেটা নন-কম্লায়েন্স এটা ফ্রড (প্রতারণা) এবং ইনসাইডার ট্রেডিং এগুলো সম্পর্কেও বলতে হবে।স্মার্ট পুঁজিবাজার, স্মার্ট সিস্টেম, ইন্টিগ্রেটেড (সমন্বিত) সিস্টেম এবং স্টক এক্সচেঞ্জের সব সিস্টেম, সিডিবিএলের সেটেলমেন্ট সিস্টেম, ব্রোকারদের ব্যাক অফিসগুলো যদি ইন্টিগ্রেটেড হলে ব্যাংকের সঙ্গে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমের লিংক থাকবে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ পদ্ধতিটি যখন স্মার্ট বা ইন্টিগ্রেটিড হবে; তখন কেউ প্রতারিত হবে না। মানুষের আস্থা আরও বাড়বে। পুঁজিবাজারকে মানুষ আরও নিরাপদ মনে করবে। বর্তমানে দুই-চারটা খারাপ উদাহরণ রয়েছে, সেটাও হবে না।
প্রশ্ন : নতুন করে যেন কোনো বিনিয়োগকারী প্রতারিত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবেন?
এটিএম তারিকুজ্জামান : ব্রোকার ডিলার কিংবা ট্রেডার এবং অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিনিয়োগকারীরা যেন নিরাপদ জায়গা মনে করেন। তারা যেন মনে করেন, আমার টাকা আছে, টাকা থাকবে; শেয়ার আছে শেয়ার থাকবে। তার জন্য অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন করতে হবে। আইটির উন্নতি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করবেন, তার জন্য টেকনোলোজিক্যালি আমাদের স্মার্ট হতে হবে।রেকর্ড কিপিং অনলাইন বেজড করতে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। অত্যাধুনিক সেফ একটি সফটওয়্যার থাকবে। যেখানে কোনো নিরাপত্তার হুমকি থাকবে না। বিনিয়োগকারীরা নিজের বিও অ্যাকাউন্টে ঢুকে তাদের শেয়ার ও টাকা সব কিছু দেখতে পারবেন। সেখান থেকে নড়চড় হওয়ার সুযোগ নেই। একজন বিনিয়োগকারী অর্ডার দেওয়া কিংবা না বলা পর্যন্ত নড়চড় হয় না।
প্রশ্ন : ডিএসইর টেকনিক্যাল সমস্যার বিষয় কী ভাবছেন?
এটিএম তারিকুজ্জামান : পুঁজিবাজারে অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি লাগবে। তাহলে টেকনিক্যাল সমস্যা কমবে।সাইবার ঝুঁকি যেন না থাকে সে রকম সিস্টেম আমাদের ব্যবহার করতে হবে। যেখানে থাকবে ডিজাস্টার রিকভারি সিস্টেম। সবমিলে বর্তমান যে টেকনোলজি রয়েছে তার চেয়ে মডার্ন টেকনোলজি ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই দ্রুত লেনদেন হবে। সেটা করতে পারলে লেনদেনের পরিমাণও বাড়বে।
প্রশ্ন : ডিএসইর সফটওয়্যার ভেন্ডর ভিত্তিক, এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে?
এটিএম তারিকুজ্জামান : এখন সময় এসেছে নিজেদের সফটওয়্যার তৈরি করার। ভেন্ডর নির্ভর থাকলে অনেক সমস্যা। তার মধ্যে একটি হলো─ কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাদের কাছে যোগাযোগ করতে হয়। তাদের সময়-সুযোগের ওপর নির্ভর করতে হয়। টাকা খরচ হচ্ছে কিন্তু সমস্যাও সমাধান হচ্ছে না।এখন দেশে অনেক মেধাবী রয়েছে, তাদের দিয়ে দেশীয় সফটওয়্যার তৈরি করতে পারি। যাতে বিদেশি ভেন্ডরের কাছে না যেতে হয়। দেশ যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, পুঁজিবাজারও সেখানে এগিয়ে যাবে।
প্রশ্ন : কারসাজি বন্ধে আপনার পদক্ষেপগুলো কী থাকবে?
এটিএম তারিকুজ্জামান : শেয়ার কারসাজি বন্ধে প্রাথমিক রেগুলেটর হিসেবে আমরা আমাদের কাজ করব। বাজারে যাতে কেউ প্রতারিত না হয়। সবাই যাতে ফেয়ারলি লেনদেন করতে পারে, সার্ভেইল্যান্স সফটওয়ারে দেখা হবে। কেউ যদি আনইউজুয়ালি, অস্বাভাবিক কোনো কিছু করে থাকে, তাহলে সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এটাকে আরও শক্তিশালী করা লাগবে। মার্কেট ম্যানুপুলেশন যাতে না হয় ডিএসই ও বিএসইসি মিলে নজরদারি বাড়াবে। ম্যানুপুলেশন বাজারের সুশাসন নষ্ট করে, সেই সুশাসন বাড়াতে হবে।
প্রশ্ন: কেমন পুঁজিবাজার গড়তে চান?
এটিএম তারিকুজ্জামান : ডিএসইকে সারাবিশ্বের পুঁজিবাজারের গর্বের জায়গা নিয়ে যাব। বিশ্বের অন্যতম সম্পদ ও গর্বিত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলব। এটা শুধু দেশের সম্পদ হবে না; প্রত্যেকটা মানুষের সম্পদ হবে। এখানের একজন বিনিয়োগকারী ও ইন্টারমেডিট থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারাও উপকৃত হবেন।সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই এসেছি, ভয় লাগছে, পারব না এই রকম কোনো শঙ্কা নেই। যত চ্যালেঞ্জ আসবে, সব চ্যালেঞ্জ বরফের মতো গলে যাবে। দুষ্টু লোকজন বিজয়ী হতে পারবে না। কারণ তারা দেখবে যে জিনিসটা তো ভালো। তাই তারা আসবে না। সব কিছু চলে গেলেও আমার হাত দিয়ে খারাপ কিছু হবে না। এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। যেহেতু আমি খারাপ হব না। আমি সবাইকে ভালো করতে পারব।দেশে-বিদেশে কাজ করেছি, কখনো হারিনি। আমার পলিসি হচ্ছে, আমি কোচ ও রেফারি হিসেবে কাজ করব। আমি প্রথম কোচ হিসেবে কাজ করব। সেখানে আমার কাজ হবে দেখার। ‘আই নো দ্য জব’(আমি কাজ সম্পর্কে জানি), আই উইল শো দ্য জব (আমার কাজ দেখাব), এবং আমি তাকে বলব এই কাজ করতে। তখন যারা খারাপ কাজ করবে তাদের সতর্কতার জন্য হলুদ কার্ড দেব। আমি চাই তারা সংশোধন হোক। যদি তারা এতে সংশোধন না হয়, তাহলে বলব, ‘দিস ইজ রেড কার্ড’।