প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন এরকম সফরে যান, তখন হাজার হাজার প্রবাসী ভারতীয় তাকে দেখতে ভিড় করেন। রাহুল গান্ধীর বেলায় অবশ্য সেরকমটা হয়নি।
রাহুল গান্ধী এখন আর পার্লামেন্ট সদস্য নন, বিরোধী দলের নেতাও নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতীয় কংগ্রেসের আন্তর্জাতিক শাখা, ভলান্টিয়ার্স অব দ্য ইন্ডিয়ান ওভারসীজ কংগ্রেস মি. গান্ধীর অনুষ্ঠান-স্থলগুলো ভরানোর জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় মানুষ জড়ো করতে সক্ষম হয়েছিল।
মি. গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি শহর সফর করছেন এ সপ্তাহে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে যাচ্ছেন।
তার এই সফরটা হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন মাত্রই কংগ্রেস দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে।
রাহুল গান্ধী সম্প্রতি তার ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ কর্মসূচীর মাধ্যমে ভারতে একটা উদ্দীপনা তৈরি করতে সক্ষম হন। এই কর্মসূচীর মাধ্যমে তিনি পাঁচ মাস ধরে পুরো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন। প্রতিটি সভায় তিনি এই কর্মসূচীর সাফল্যের কথা উল্লেখ করছেন।
এই সফরের সময় তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তার সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি ভারতীয়-আমেরিকান সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও করেন সিলিকন ভ্যালিতে তাদের সাফল্য এবং তাদের কর্মনিষ্ঠার প্রশংসা করে।
স্ট্যানফোর্ডে রাহুল গান্ধীর বক্তৃতা শোনা এবং তার সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা লাইন দিয়েছিল। প্রবাসী ভারতীয়দের আরেকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকরা তার ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র কথা উল্লেখ করে হাত তুলে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার ডাক দেন।
ইন্ডিয়ান ওভারসীজ কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন স্যাম পিট্রোডা এই পদযাত্রাকে মি. গান্ধীর রাজনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ‘বাঁক-বদল’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “এই পদযাত্রার কারণেই আজ এখানে এত উদ্দীপনা দেখতে পাচ্ছেন।”
কিন্তু একজন ভারতীয় রাজনীতিক, আন্তর্জাতিকভাবে যার সেরকম বিপুল পরিচিতি বা সমর্থন নেই, তিনি কেন প্রবাসী ভারতীয়দের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন?
যুক্তরাষ্ট্রে যত দেশের অভিবাসীরা থাকেন, তাদের মধ্যে ভারতীয়-আমেরিকানদেরই গড়পড়তা আয় সবচেয়ে বেশি। এরা মার্কিন এবং ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোতে বিরাট অংকের চাঁদা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ভোটার এবং প্রার্থী হিসেবে এরই মধ্যে ভারতীয়-আমেরিকানরা বড় ভূমিকা পালন করছে। এদের গুরুত্ব এখন আর কেবল ‘সফট পাওয়ারের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তাদের গুরুত্ব এখন তার চেয়ে বেশি।
২০১৯ সালে চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, অন্যান্য এশিয়ান-আমেরিকানদের তুলনায় ভারতীয় সম্প্রদায়ই ব্যক্তিগতভাবে ডেমোক্রেটিক প্রার্থীদের সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিয়েছে।
দেশের বাইরে এসে যখন কেউ গণমাধ্যমে ইতিবাচক প্রচার পান, ভারতে নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা বাড়াতে তার একটা ভূমিকা থাকে, বলছেন মিলান বৈষ্ণব, যিনি ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা কার্নেগী এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের একজন গবেষক।
কিন্তু ভারতের নির্বাচনে সাম্প্রতিক সাফল্যের ভিত্তিতে নিজেকে যোগ্যতর বলে প্রমাণ করা মি. গান্ধীর জন্য বেশ কঠিন হবে, বলছেন টেম্পল ইউনিভার্সিটির সঞ্জয় চক্রবর্তী। তিনি ‘দ্য আদার ওয়ান পার্সেন্ট: ইন্ডিয়ানস ইন আমেরিকা’ বইয়ের লেখক।
“মি. গান্ধী হয়তো আন্তর্জাতিকভাবে একটি ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু অনেক পরিমণ্ডলে তিনি অনেকটা পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন”, বলছেন মি. চক্রবর্তী। “কাজেই তিনি নিজেকে এখন বেশ গভীর একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন যাতে সবাই তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়।”
তবে মি. বৈষ্ণব মনে করেন রাহুল গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফর সময়োপযোগী হয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রে আসবেন বলে কথা রয়েছে। তিনি হোয়াইট হাউজে তার সম্মানে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে যোগ দেবেন।
মি. বৈষ্ণব বলেন, “এসব বিষয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন। একজন বিদেশী রাজনীতিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে এটাই আসলে সর্বোচ্চ সম্মান, যা কেউ পেতে পারেন। কাজেই এর সঙ্গে সরাসরি তুলনা কিন্তু করা হবেই।”
তিনি আরও বলেন, “প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে মি. মোদীর আবেদন রীতিমত একজন রক-তারকার মতো, এটা একেবারেই অনন্য।”
অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের যত বেশি উত্থান হচ্ছে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের মৈত্রী যত শক্তিশালী হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে এবং ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতীয়-আমেরিকানদের প্রভাবও তত বাড়ছে।
প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা প্রথম শুরু করেছিলেন সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী ২০০০ সালের পর হতে।
নরেন্দ্র মোদী যখন ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, তখন নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন তাকে উল্লাস করে স্বাগত জানিয়েছিল প্রায় ২০ হাজার ভারতীয়-আমেরিকান।
“বিশ্বে আর কোন নেতা কি আছেন, যিনি ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন কানায় কানায় পূর্ণ করার মতো দর্শক আকর্ষণের ক্ষমতা রাখেন বা স্পর্ধা দেখাতে পারেন? আমি তো আর কাউকে দেখি না,” বলছেন মি. বৈষ্ণব।
এরপর ২০১৯ সালে হিউস্টনে আরেকটি অনুষ্ঠানে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মি. মোদীকে দেখার জন্য জড়ো হয়েছিল ৫০ হাজার ভারতীয়-আমেরিকান। যুক্তরাষ্ট্রে কোন বিদেশি নেতার জন্য এটাই ছিল এ যাবত সবচেয়ে বড় সম্বর্ধনা, পোপকে বাদ দিলে। মি. ট্রাম্প এটিকে ‘অসাধারণ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
ভারতীয় নেতাদের বিদেশে এরকম বিশাল জনসভার নজির এর আগে আর নেই, বলছেন মি. চক্রবর্তী। “ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীরা বহুবার এসেছেন, উচ্চপর্যায়ের নেতা-কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, বাণিজ্য নিয়ে দরকষাকষি করেছেন, আলোচনা করেছেন। কিন্তু তারা এখানে এরকম বিশাল জনসংযোগ অনুষ্ঠান করেননি। নরেন্দ্র মোদীর স্টাইলটাই হচ্ছে বড় বড় অনুষ্ঠান করে নিজেকে তুলে ধরা।"
কিন্তু ভারতীয়-আমেরিকানরা, যাদের ভারতে কোন ভোট নেই, তারা কেন ভারতীয় রাজনীতিকদের এতটা পাত্তা দেয়?
এর কারণ, ভারতীয়-আমেরিকানরা তাদের ফেলে আসা মাতৃভূমির সঙ্গে একটা গভীর পারিবারিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে। অনেকের সেখানে ব্যক্তিগত বিনিয়োগও আছে, সেটা নিয়ে তারা ভাবেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা পূজা লাখিয়া বলেন, ভারতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে ভাল ভাল চাকুরি করে। “অনেকে হয়তো ফিরে যাবে বা এখানে থেকে যাবে, কিন্তু আমাদের অনেকেরই ভারতে বিনিয়োগ আছে- আছে জমি, বাড়ি, শেয়ার”, বলছেন তিনি।
মিজ লাখিয়া জানান, তিনি ‘মোদীর ভক্ত।’ তিনি মনে করেন, প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ভারতীয় রাজনীতিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাহুল গান্ধী ভারতীয়-আমেরিকানদের জন্য যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, তিনি সেখানে যাওয়ার কোন আগ্রহ দেখাননি।
ভারতীয়-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ-শিক্ষিত মানুষের হার অনেক বেশি। তারা স্বীকার করেন যে, ভারতের সরকারী উচ্চ-শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধাভোগী তারা।
অন্যদিকে ভারতীয় অর্থনীতিও তাদের পরিশ্রমী প্রবাসী নাগরিকদের কারণে অনেক সুফল পায়। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত বছর এই প্রবাসী ভারতীয়রা ১০৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছে ভারতে।
ভারতীয়রা যুক্তরাষ্ট্রে আয়েশি জীবন-যাপন করে দেশের রাজনীতিতে মাথা গলায়- এরকম একটা সমালোচনা প্রায়শই শোনা যায়। কিন্তু প্রবাসী ভারতীয়রা মনে করেন, তারা যে ভারতীয় রাজনীতিকদের নিয়ে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন, তা দেশের ভারতীয়দের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা বার্তা দেয়। “আমাদের মন দেশেই পড়ে আছে”, বলছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ট্রাস্টি অনু মৈত্র, যারা মি. গান্ধীকে নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজক।
“বিদেশে থাকলেই আপনি পর হয়ে গেলেন ব্যাপারটা তো এরকম নয়”, বলছেন তিনি। “আপনি আশা করেন আমরা রেমিটেন্স পাঠিয়ে ব্যাল্যান্স অব পেমেন্টের সমস্যা থেকে দেশকে রক্ষা করবো, কিন্তু আমরা কথা বলতে পারবো না, এটা তো হয় না। ”
সিলিকন-ভ্যালী ভিত্তিক উদ্যোক্তা তালাত হাসান বলেন, প্রথম প্রজন্মের অনেক ভারতীয়ের সঙ্গেই দেশের বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকে। “স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে আমরা যারা বেড়ে উঠেছি, আমাদের মধ্যে দেশ-প্রেমের বোধ বেশ শক্তিশালী”, বলছিলেন তিনি।
বলিউডের ‘স্বদেশ’ নামের একটি ছবিতে যেরকম দেখানো হয়েছে, অনেক ভারতীয়-আমেরিকান দেশে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, যাতে তারা দেশকে কিছু ফিরিয়ে দিতে পারেন। এই ছবিতে শাহরুখ খান একজন ভারতীয়-আমেরিকান নাসা বিজ্ঞানীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি দেশে ফিরে যান তার গ্রামের উন্নয়নের জন্য।
ছবিটি তৈরি করা হয় রবি কুচিমাঞ্চি নামে এক ভারতীয়-আমেরিকান প্রকৌশলীর সত্যিকারের জীবন-কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে। এ সপ্তাহে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় যান রাহুল গান্ধীর বক্তৃতা শুনতে।
মি. কুচিমাঞ্চি বলেন, “রাহুল গান্ধীকে আমার একজন সৎ মানুষ বলেই মনে হয়েছে। অনাবাসী ভারতীয়রা তাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারে, সেটা তার বলা উচিৎ।”
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অঞ্জলি অরুনদেকার বলেন, “প্রবাসী ভারতীয়রা যে ভারতকে সাহায্য করতে চায়, এটা শুধু আবেগের ব্যাপার নয়। আমরা বিরাট অংকের রেমিটেন্স দেশে পাঠাই সেটাও বড় কারণ নয়। এর কারণ আসলে, যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় তরুণরা দেশের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রাখতে চায়।”
ভারতীয় রাজনীতিকদের জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে মেলা-মেশার সুযোগ আরও বাড়ছে।
রাহুল গান্ধীর জন্য স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজকদের একজন ছিলেন ডিনশা মিস্ত্রি। তিনি বলেন, ক্যালিফোর্নিয়া সফরে আসা বিখ্যাত ভারতীয় রাজনীতিকরা এখন তাদের ‘দল-নিরপেক্ষ ক্যাম্পাসে’ একবারের জন্য হলেও আসতে চান। অনুষ্ঠানে রাহুল গান্ধীর পাশে বসেই তিনি পরেরবার মি. মোদীকে এরকম সফরে আসার খোলামেলা আমন্ত্রণ জানালেন।