বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে সরকারি হিসেবেই প্রতিদিন দু হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি মৌসুমে বুধবার পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১৯ হাজার ১৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আর মোট মারা গেছে ৫৬৯ জন।
ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার কামড়ে একজন মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। চিকিৎসকরা বলছেন সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে পারলে এ রোগে মৃত্যু ঝুঁকি খুব একটা থাকে না। কিন্তু রোগটিকে অবহেলা করলে এটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি অবশ্য বলছে প্রতি চার জনে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে এবং মারাত্মক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন দ্রুতই হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে।
সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে সাধারণত জ্বরই এ রোগের লক্ষণ। সাথে বমি, র্যাশ ওঠা, চুলকানি বা ব্যথার উপসর্গ থাকতে পারে। তবে লক্ষণগুলো সাধারণত দুই থেকে সাতদিন পর্যন্ত থাকে এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই বেশিরভাগ রোগী সুস্থতার দিকে চলে আসেন। তবে চিকিৎসকরা বলছেন যে জ্বর কমলে বা রোগী ভালো হয়ে যাওয়ার পর রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে এবং তখনি রক্তক্ষরণসহ নানা জটিলতা দেখা দিত পারে। এ কারণে জ্বর চলে যাওয়ার পর রোগীকে সতর্ক থেকে নিয়ম অনুযায়ী চলতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। সিডিসি বলছেন ডেঙ্গু রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। বরং এর লক্ষণগুলো দেখে চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। (যেমন জ্বর হলে জ্বরের ঔষধ)।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক সাজ্জাদ হোসেন বলছেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সাধারণত ডেঙ্গু এনএস১ এন্টিজেন, অ্যান্টিবডি পরীক্ষা, সিবিসি (প্লাটিলেট কাউন্টসহ) পরীক্ষা করাই যথেষ্ট হয়ে থাকে। তবে রোগীর অবস্থা জটিল হলে বা রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা গিলে তখন আরও কিছু টেস্ট করানো দরকার হয়ে থাকে।
কোন টেস্ট করাতে হবে
বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষা মৌসুমে এই জ্বরে আক্রান্ত হবার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায় এবং ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছরেই এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
সিডিসি বলছে ডেঙ্গু হয়েছে কি-না সেটি বোঝার একমাত্র উপায় হলো রক্ত পরীক্ষা। তবে চিকিৎসকরা বলছেন রক্তের বেশ কিছু পরীক্ষা আছে যেগুলোর এক বা একাধিক অনেক সময় করাতে হয় রোগীর অবস্থা বুঝে।
সাধারণত যেসব পরীক্ষা করাতে হয় তার কয়েকটি সম্পর্কে কিছু তথ্য নীচে দেয়া হলো:
ডেঙ্গু এনএস ১
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলছে এই টেস্টের মাধ্যমে কেউ ডেঙ্গু পজিটিভ কি-না সেটি দেখা যায়। ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হবার শুরুর দিকেই এ পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটিকে শনাক্ত করা যায়। ঢাকায় চিকিৎসকরা বলছেন জ্বরের প্রথম দিন থেকেই ডেঙ্গু এনএস১ টেস্টের ফল পজিটিভ হওয়ার কথা। চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে হলে এটি নেগেটিভ হয়ে যায়। কিন্তু এর বেশি দিন হয়ে গেলে তখন আর এই পরীক্ষা করে খুব একটা লাভ হয় না।
আবার শুরুতেই পরীক্ষা করে নেগেটিভ হলেই যে ডেঙ্গু জ্বর হয়নি এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সাধারণত চিকিৎসকরা টেস্টের ফলাফলের সাথে অন্য উপসর্গ ও লক্ষণ মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কারণ অনেক সময় এনএস১ একদিন পজিটিভ হলে পরদিনই আবার নেগেটিভ হতে পারে। সাজ্জাদ হোসেন বলছেন সাধারণত জ্বর আসার প্রথম দিনই এই টেস্ট করাতে পারলে ফলাফল ঠিকঠাক মেলার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
ডেঙ্গু আইজিএম
সিডিসি বলছে এই টেস্টের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস আরও ভালোভাবে শনাক্ত করা যায়। সাধারণত জ্বর হয়ে যাওয়ার ৪/৫ অতিবাহিত হয়ে গেলে এবং এর মধ্যে কোনো পরীক্ষা না হয়ে থাকলে এই পরীক্ষার মাধ্যমে পজিটিভ কি-না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই সাধারণ ভাবে জ্বর আসার পাঁচ দিন পর এই টেস্ট করতে দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু যদি জ্বর আসার পর ৯/১০ দিন পার হয়ে যায় তখন আবার এই পরীক্ষাও শুধু নেগেটিভ দেখাতে পারে। কারো জ্বর হওয়ার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ষষ্ঠ দিনের মাথায় এই পরীক্ষাটি করানো, যা ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত করা যায়। রক্তে আইজিএম পজিটিভ থাকলে বুঝতে হবে বর্তমানে রোগীর সংক্রমণ রয়েছে।
উপজেলা পর্যায়ে একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক মোঃ রায়হান বলছেন এনএস১ এর সময়সীমা পার হয়ে গেলে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমেই ডেঙ্গু পজিটিভ কি-না তা দেখা যায় এবং এজন্য প্রথমে আইজিএম ও এরপর আইজিজি টেস্ট করে দেখার দরকার হতে পারে।
আইজিজি
ডাঃ সাজ্জাদ হোসেন বলছেন শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা আছে সেটা বোঝার জন্য চিকিৎসার এ পরীক্ষাটি দিয়ে থাকেন। "এই রোগ প্রতিরোধী সক্ষমতাই শরীরের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসসহ বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অ্যান্টিবডিগুলো হলো প্রোটিন যা ইমিউন সিস্টেম তৈরি করে জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য"। আইজিজি সূচক স্বাভাবিকের চেয়ে কম মানে হলো শরীর যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করতে অক্ষম এবং সেক্ষেত্রে সংক্রমণে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রক্তে আইজিজি পজিটিভ থাকলে বুঝতে হবে আগে রোগীর সংক্রমণ ছিল এবং বর্তমানে সে দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া মানে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং তখন বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে।
কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি
ডাঃ সাজ্জাদ হোসেন বলছেন শরীর সম্পর্কে একটি বেসিক ধারণার জন্য এ পরীক্ষাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি মূলত একটি সামগ্রিক রক্ত পরীক্ষা। সিবিসি টেস্ট হিসেবে পরিচিত হলেও এটি আসলে একটি টেস্ট প্রোফাইল। এর মধ্যে রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এ টেস্টের মাধ্যমে রক্তের প্রয়োজনীয় কোষীয় উপাদানের ঘনত্বের পরিমাপের পাশাপাশি শরীরে কোন অস্বাভাবিকতা আছে কি-না তা পর্যালোচনা করা হয়। অর্থাৎ রোগী কোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছে কি-না, রক্তকণিকা স্বাভাবিক কি-না বা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কেমন এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝার জন্য চিকিৎসকরা এ টেস্ট দিয়ে থাকেন। যেমন ফুসফুস থেকে দেহের অন্য অংশে অক্সিজেন নেয়ার কাজটি করে লোহিত রক্তকণিকা কিংবা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে শরীরকে সংক্রমণ থেকে রক্ষার চেষ্টা করে শ্বেত রক্তকণিকা কিংবা রক্তপাত বন্ধ করতে ও রক্ত জমাট বাঁধতে ভূমিকা রাখে প্লাটিলেট। এগুলোর জন্য সিবিসি টেস্টই করতে হয়।
আবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর জন্য হেমাটোক্রিট দেখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। রক্তের কতটা অংশ জুড়ে লোহিত কণিকা সে সম্পর্কে জানা যায় হেমাটোক্রিট দেখে। আবার হেমাটোক্রিট, হিমোগ্লোবিন ও লোহিত কণিকার মাত্রা কম থাকলে রক্ত স্বল্পতায় আক্রান্ত হবার আশংকা থাকে। পাশাপাশি দেখা দিতে পারে শরীরে অতিরিক্ত পানি, অস্থিমজ্জার সমস্যা কিংবা লিউকোমিয়ার মতো রোগও।
প্রথ্রোমোবিন টাইম বা পিটি
প্রথ্রোমোবিন টাইম বা পিটি হলো এমন একটি পরীক্ষা যার মাধ্যমে রক্তের তরল অংশের প্লাজমা জমাট বাঁধতে কতটা সময় নেয় তা পরিমাপ করে। ক্লটিং বা জমাট বাঁধার সিস্টেমের একটি অংশের কার্যকারিতা এ পরীক্ষায় পরিমাপ করা যায়। সাধারণত অস্বাভাবিক রক্তপাত এর কারণ নির্ধারণে কিংবা লিভার কতটা ভালো কাজ করছে সেটি জানারও জন্য চিকিৎসক অনেক সময় এ টেস্টটির পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ইন্টারন্যাশনাল নর্মালাইজড রেশিও বা আইএনআর
ইন্টারন্যাশনাল নর্মালাইজড রেশিও বা আইএনআর এমন একটি রক্ত পরীক্ষা যার মাধ্যমে জানা যায় যে রক্ত জমাট হতে কতটা সময় লাগে। মূলত পিটি পরীক্ষার মাধ্যমে কত দ্রুত রক্ত জমাট বাঁধছে জানার পর সেই ফলগুলোকেই আইএনআর হিসেবে প্রকাশ করা যায়। তখন জানা যায় যে ঠিক কতটা সময় লাগছে রক্ত জমাট বাঁধতে।
ব্লিডিং টাইম ক্লটিং টাইম বা বিটিসিটি
ব্লিডিং টাইম ক্লটিং টাইম বা বিটিসিটি পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের তেরটি ফ্যাক্টর নির্ণয় করা যায়। সাধারণত অপারেশনের আগে এই পরীক্ষা করা হয়। ফলে এর মাধ্যমে চিকিৎসক একটি ধারণা পান যে অপারেশনের পর রোগীর রক্ত জমাট বাঁধতে কতক্ষণের মধ্যে। ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে এ টেস্ট খুব একটা দরকার হয় না। তবে চিকিৎসক যদি মনে করেন বিশেষ জটিলতায় আক্রান্ত তখন এ টেস্ট করার পরামর্শ দিতে পারেন। চিকিৎসক সাজ্জাদ হোসেন বলছেন মূলত ব্লিডিং ডিজঅর্ডার সম্পর্কে বোঝার জন্যই এসব পরীক্ষা করতে হয়।এছাড়াও নানা ধরণের পরীক্ষা আছে যেগুলো রোগীর অবস্থা বুঝে প্রয়োজন হলে চিকিৎসকরা করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারেন।