শেয়ার বাজার

উ. কোরিয়ায় অনাহারে মৃত্যুর করুণ কাহিনি, দেশ কি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে?

উ. কোরিয়ায় অনাহারে মৃত্যুর করুণ কাহিনি, দেশ কি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে?
সারাবিশ্ব লাইফস্টাইল

উত্তর কোরিয়ার কজন মানুষ বিবিসিকে জানিয়েছেন সেদেশে খাদ্যাভাব এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে তাদের প্রতিবেশিদের তারা অনাহারে মারা যেতে দেখেছেন।

উত্তর কোরিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ। সেখান থেকে খবর বাইরে আসে না। সেই দেশের ভেতর থেকে বিবিসি কিছু মানুষের একান্ত সাক্ষাৎকার গোপনে জোগাড় করেছে। এইসব সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশটির পরিস্থিতি ১৯৯০এর দশকের চেয়েও গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশটির সরকার তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয় ২০২০ সালে। ফলে সবরকম সরবরাহের পথ বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আমাদের যারা সাক্ষাৎকার দেন তারা বলেন যে সরকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপরও কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।

পিয়ংইয়ং সরকার বিবিসিকে বলেছে তারা সবসময়ই সেদেশের নাগরিকদের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়।

বিবিসি কয়েক মাস ধরে গোপনে উত্তর কোরিয়ার তিনজন সাধারণ নাগরিকের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছে। বিবিসিকে একাজে সহযোগিতা করেছে ডেইলি এনকে নামে একটি সংস্থা, যাদের উত্তর কোরিয়ার ভেতর থেকে খবর সংগ্রহের জন্য লোকজনের একটা নেটওয়ার্ক রয়েছে।

তারা আমাদের বলেছে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে তারা হয় অনাহারে মৃত্যু অথবা আইনভঙ্গের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। উত্তর কোরিয়ার মানুষের মুখ থেকে সরাসরি কিছু শুনতে পাওয়া একটা বিরল ব্যাপার।

কোরিয়দের ব্যবহৃত বাতাসে দোল খায় এমন গৃহসজ্জার চাইম 

এই সাক্ষাৎকারগুলো তুলে ধরেছে দেশটিতে কীভাবে “একটা বিপর্যয়কর মর্মান্তিক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে”- বলছেন লিবার্টি ইন নর্থ কোরিয়া (লিংক) নামে একটি সংস্থার সোকেল পার্ক। এই সংস্থাটি উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা লোকেদের সাহায্য করে।

রাজধানী পিয়ংইয়ংএর বাসিন্দা এক নারী আমাদের বলেন, তিনি তিনজনের একটি পরিবারকে জানতেন যারা না খেয়ে নিজেদের বাসায় মারা গেছেন। “আমরা তাদের পানি দেবার জন্য দরোজায় কড়া নাড়ি, কিন্তু কেউ দরোজা খোলেনি,” বলেন জি ইয়ন। কর্তৃপক্ষ যখন বাসার ভেতর ঢোকে, তাদের তিনজনকে তারা মৃত দেখতে পায়, তিনি বলেন। জি ইয়নের পরিচয় গোপন রাখতে তার নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। আমরা অন্য যাদের সাথে কথা বলেছি তাদেরও আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি।

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীন সীমান্তের কাছাকাছি বাস করেন একজন নির্মাণ কর্মী। আমরা তার নাম দিয়েছি চান হো।

চান হো আমাদের বলেন খাবারের সরবরাহ এখন এতটাই কম যে তার গ্রামের পাঁচজন ইতোমধ্যেই অনাহারে মারা গেছে।

“প্রথম দিকে আমার ভয় ছিল কোভিডে মরব, কিন্তু এরপর থেকে ভয় ধরে গেল যে না খেয়ে মরতে হবে,” তিনি বলেন।

দেশটির দুই কোটি ৬০ লক্ষ মানুষের জন্য উত্তর কোরিয়া কোন দিনই যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করতে পারেনি। কিন্তু ২০২০এ দেশটি যখন সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, তখন কর্তৃপক্ষ চীন থেকে খাদ্যশস্য, সেইসঙ্গে খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সার ও কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি আমদানিও বন্ধ করে দেয়।

ইতোমধ্যে পিয়ংইয়ং কর্তৃপক্ষ সীমানায় বেড়া তুলে ঢোকার সব পথ নিশ্চিদ্র করে দেয় এবং খবর প্রকাশ পায় যে কেউ সীমান্ত পেরনোর চেষ্টা করলে সীমান্তরক্ষীদের তাদের গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফলে, কারো পক্ষে চোরাই পথে খাবার এনে বেসরকারি বাজারে বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। উত্তর কোরিয়ার বেশিরভাগ মানুষ এসব বাজার থেকেই সাধারণত খাদ্যপণ্য কেনেন।

দেশের উত্তরাঞ্চলের এরকম বাজারের একজন ব্যবসায়ী যার নাম আমরা দিয়েছি মিয়ং সুক, আমাদের বলেন যে, তার স্থানীয় বাজারে প্রায় তিন চতুর্থাংশ খাবারদাবারই আসত চীন থেকে। এখন সেসব বাজার “একেবারে খালি”।

অন্য আরও অনেকের মত মিয়ং সুকও সীমান্তের ওপার থেকে চোরাচালান হয়ে আসা পণ্য এই বাজারে বেচে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন তার রোজগারের পথও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আমাদের বলেন তার পরিবার এর আগে কখনও এত কম খেয়ে দিন কাটায়নি। সম্প্রতি প্রতিবেশিরাও তার দরজায় কড়া নেড়ে খাবার চায়, কারণ খাবারের অভাবে তারা না খেয়ে চরম ক্ষুধায় দিন কাটাচ্ছে।

জি ইয়ন পিয়ংইয়ং থেকে আমাদের জানান তিনি শুনেছেন মানুষ খিদের জ্বালায় ঘরের ভেতর আত্মহত্যা করেছে, অনেকে আয় রোজগার হারিয়ে পাহাড়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে সেখানে মরবে বলে।

মিজ জি বলেন বাচ্চাদের খাওয়া দিতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। একবার, দুদিন তিনি অভুক্ত ছিলেন। তার ভয় হয়েছিল ঘুমের মধ্যেই তিনি মারা যাবেন।

উত্তর কোরিয়ায় ১৯৯০এর দশকের শেষ দিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। ওই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল ৩০ লাখ মানুষ।

সম্প্রতি দেশটিতে মানুষের অনাহারে থাকার কিছু গুজব শোনা যাচ্ছিল। তা যে শুধু গুজব নয়, সত্য, এই সাক্ষাৎকারগুলোই তার প্রমাণ এবং এর থেকে একটা আশঙ্কা দানা বাঁধছে যে দেশটি আরেকটি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে।

“সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ তাদের পাড়ায় অনাহারের যেসব চিত্র দেখছে তা খুবই উদ্বেগের,” বলছেন উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিবিদ পিটার ওয়ার্ড। “আমরা বলছি না সেখানকার সমাজ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে বা সেখানে গণহারে মানুষ এখন অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, কিন্তু চিত্রটা মোটেই সুখকর নয়।”

উত্তর কোরিয়ায় মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা নথিবদ্ধ করে এনকেডিবি নামে একটি সংস্থা। তার পরিচালক হানা সং-ও একই কথা বলছেন। “গত ১০-১৫ বছর আমরা মানুষের না খেয়ে থাকার কথা কালেভদ্রে শুনেছি। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের উত্তর কোরিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসময়ের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”

এমনকি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং আনও পরিস্থিতি যে কতটা গুরুতর তার প্রতি ইঙ্গিত করেন একসময় “খাদ্য সঙ্কট” কথাটা সরাসরি উল্লেখ করে, যখন কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের প্রয়াসের কথা তিনি বলেন। এরপরেও, তিনি কিন্তু তার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির জন্য ব্যয়বরাদ্দকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ২০২২ সালে তিনি রেকর্ড সংখ্যায় ৬৩টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালান।

একটি আনুমানিক হিসাব বলে এসব পরীক্ষার জন্য দেশটি খরচ করেছে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ, যা উত্তর কোরিয়ার বার্ষিক খাদ্যশস্য ঘাটতি পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের চেয়ে অনেক বেশি।

আমাদের যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তারা একথাও বলেছেন যে গত তিন বছরে সরকার কীভাবে জনসাধারণের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল নিয়েছে। সরকার নতুন নতুন আইন চালু করেছে এবং শাস্তি কঠোর করেছে।

দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্যানডেমিকের আগে প্রতি বছর ইয়ালু নদী পার হয়ে উত্তর কোরিয়া ছেড়ে চীনে পালাতো হাজার খানেকের বেশি মানুষ।

ছোট ব্যবসায়ী মিয়ং সুক আমাদের বললেন এখন পালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। “এখন এমনকী নদীর দিকে যাবার চেষ্টা করলেই কড়া শাস্তি দেয়া হয়। ফলে প্রায় কেউই আর নদী পার হয় না,” তিনি বলেন।

নির্মাণ কর্মী চান হো বলেন , তার বন্ধুর ছেলে সম্প্রতি রুদ্ধদ্বার কক্ষে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়া তিন চার জনকে এক সাথে হত্যা করা হয়েছে। “বেঁচে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে,” তিনি আমাদের বলেন। “একটা ভুল করলেই নির্ঘাত মৃত্যু।”

“আমরা এখানে আটকা পড়ে মরণের অপেক্ষায় দিন গুনছি।”

তিন বছরের ওপর উত্তর কোরিয়া তার সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছে। সেদেশে ঢোকা বা দেশ থেকে বেরনো নিষেধ। প্রায় প্রত্যেক বিদেশী যারা দেশটিতে ছিলেন তল্পিতল্পা গুটিয়ে সেদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে গোপনীয় এবং স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি থেকে কোন খবর বাইরে আসে না- তথ্যের কৃষ্ণগহ্বর দেশটি। দেশের ভেতর কী ঘটছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েক মাস ধরে বিবিসিকে তা জানিয়েছেন এই তিনজন।

আমরা যা জেনেছি তা উত্তর কোরিয়ার সরকারের কাছে আমরা তুলে ধরি। সরকার আমাদের বলে তারা “সবসময় জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে, এমনকী কঠিন সময়েও।”

“মানুষকে ভাল রাখা আমাদের অগ্রাধিকারের শীর্ষে, এমনকী কোনরকম বিচার বা চ্যালেঞ্জের মুখেও,” বলেন লন্ডনে উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের একজন প্রতিনিধি।

তারা আরও বলেন এসব খবর “পুরোপুরি তথ্যভিত্তিক নয়”। তাদের দাবি “ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেয়া এসব সাক্ষ্যপ্রমাণ এসেছে ডিপিআরকে (ডেমোক্র্যাটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া – উত্তর কোরিয়ার সরকারি নাম) বিরোধী শক্তিগুলোর কাছ থেকে।”

কিন্তু লিংক সংস্থার সোকেল পার্ক বলছেন এসব সাক্ষাৎকার কঠিন জীবন সংগ্রামের “তিনটি বাস্তবতাকে” সামনে এনেছে। “খাদ্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়েছে, মানুষের নিজেদের ভরণপোষনের স্বাধীনতা কমেছে, এবং দেশ ছেড়ে পালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।” তাদের বক্তব্য এই তত্ত্বকেই সমর্থন করে যে “উত্তর কোরিয়া আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দমনমূলক হয়ে উঠেছে।”

পিয়ংইয়ং থেকে জি ইয়ন জানান নজরদারি আর দমনপীড়ন এখন এতটাই নিষ্ঠুর পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষ এখন পরস্পরকে আর বিশ্বাস করে না।

বিদেশী চলচ্চিত্র বা টিভি শো দেখা, বিদেশী গান শোনা এবং অন্যের সাথে সেসব শেয়ার করা নিষিদ্ধ করে ২০২০র ডিসেম্বরে চালু হওয়া নতুন এক আইনের আওতায় জি ইয়নকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ ও সংস্কৃতি বর্জন আইন নামে নতুন এই আইনের লক্ষ্য হল বিদেশী তথ্য আসার পথ সমূলে বিনষ্ট করা। দক্ষিণ কোরিয়ার কোন কন্টেন্ট চালাচালি করতে গিয়ে কেউ ধরা পড়লে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান এই আইনে রাখা হয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার একজন সাবেক কূটনীতিক যিনি ২০১৯ সালে দেশত্যাগ করেন, বলেন যে বিদেশী প্রভাব দমন করার পথ যে কতটা চরমে পৌঁছেছে তা জেনে তিনি স্তম্ভিত। “কিম জং আন-এর ভয় দেশের মানুষ যদি জানতে পারে তাদের প্রকৃত অবস্থাটা কী, এবং তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়া কতটা ধনী, তাহলে তারা তাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে এবং তার বিরুদ্ধে মাথা তুলবে,” ব্যাখ্যা করেন সাবেক ঐ কূটনীতিক রিউ হিউন উ।

আমাদের সাক্ষাৎকারগুলো থেকে বোঝা যায় গত তিন বছরে কিছু মানুষের আনুগত্যে ফাটল ধরেছে।

কোভিডের আগে মানুষ কিম জং আন-কে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতো,” বলেন মিয়ং সুক। “এখন প্রায় সকলেরই মনেই তৈরি হয়েছে প্রচুর অসন্তোষ।”