বাংলাদেশের অন্যতম আর্থ-উন্নয়নবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) চলমান সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। ড. ফাহমিদা খাতুন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম
চলমান বাজার পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি আমলে নিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কেমন হওয়া উচিত?
বর্তমানে বাজারের অবস্থা এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামোয় শ্রমিকদের জীবনধারণ সম্ভব নয়। অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। খাদ্য মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে পৌঁছেছে। সুতরাং বছরে ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়িয়ে শ্রমিকদের জীবনধারণে স্বস্তি দেয়া যাবে না। বাজারে প্রতিদিনের পণ্যমূল্য দেখলে মূল্যস্ফীতির ভয়াল রূপটি উঠে আসে। আমরা নিম্নমধ্যবিত্তের বাজার সদাই পর্যালোচনা করে দেখেছি, মাছ-মাংস ছাড়াই খাবারের জন্য চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক ব্যয় ৭ হাজার টাকার ওপরে। যদি সাধারণ খাবার খরচই এত হয় তাহলে বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত খরচ, শিক্ষা খরচ, চিকিৎসা ব্যয়সহ পরিবারের মোট ব্যয় কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! শ্রমিকরা ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করেছিলেন। বাজারের সঙ্গে বিবেচনা করলে তাদের চাহিদা বেশি নয়। তবে মালিক পক্ষ বলছেন, তাদের তো মুনাফা বাড়ছে না। যেসব ক্রেতার কাছে তারা পোশাক বিক্রি করছে সেখান থেকে তারা বাড়তি দাম পাচ্ছেন না। যদিও ডলারের বিপরীতে টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে সেখানে তাদের রফতানি আয় বাড়ার কথা। কিন্তু তারা বলছেন কাঁচামালের আমদানি খরচ, পরিবহন ব্যয় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যয় ইত্যাদি বেড়েছে। তাই তাদের মুনাফা বাড়েনি। কিন্তু তাই বলে শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে দেয়া যাবে না সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে তাদেরকে একটি যৌক্তিক মজুরি না দিলে তৈরি পোশাক খাত টিকে থাকার ঝুঁকিতে থাকবে। কেননা পশ্চিমা দেশগুলো শ্রম অধিকার এবং মানবিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার।
সম্প্রতি এক গার্মেন্টস মালিক বলেন, সরকারের প্রত্যেকটা বিভাগে, প্রতিটি জায়গায় ঘুস দিতে হয়। আগামীকাল থেকে বলুক যে ঘুস লাগবে না। আমরা শ্রমিকদের বেতন বাড়িয়ে দেব। ওই গার্মেন্টস মালিকের এ বক্তব্যের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
আমরা সবাই শুনে আসছি আমাদের দেশে ঘুস বা দুর্নীতির চর্চাটা অনেক বেশি এবং সরকারি সেবা পেতে সবাইকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। যদি কেউ ঘুস না দিতে চায় তাহলে তার কাজ বিলম্বিত হয় কিংবা কখনো কখনো কাজটা হয়ই না। এ টাকা দেয়াটাকে ঘুস না বলে অনেকে বলেন স্পিডমানি। নাম যা-ই হোক না কেন কাজ করাতে কিন্তু অর্থ দিতে হচ্ছে। এ ধরনের অর্থের লেনদেন বন্ধ করা এত সহজ নয়। যেহেতু এটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। অনিয়মটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। এটা বন্ধ করতে হলে কঠোর হস্তে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অথচ সরকারি সেবার জন্য জনগণ তো কর দিচ্ছেই। তাহলে এ বাড়তি অর্থ কেন? পুরো প্রশাসনিক কাঠামোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্প খাত আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কারণ আমরা শিল্পায়নকে এখনো বহুমুখী করতে পারিনি। আমাদের শিল্প খাত এই একটি খাতের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু শিল্প খাত নয়, আমাদের পুরো অর্থনীতির ভিত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা বড় অংশ আসে এ খাত থেকে। এ খাতের বাধাগুলো দূর করতে না পারলে এবং খাতটিকে দুর্নীতি মুক্ত করতে না পারলে এ খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে না।
শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন না করলে মজুরি বাড়ে না কেন?
পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য একটি মজুরি বোর্ড গঠিত রয়েছে। যেখানে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি থাকে। এই বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্য হলো, ত্রিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা। প্রতি পাঁচ বছর পর পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, শ্রমিকদের চাহিদার অনেক নিচে মজুরি বোর্ড মজুরি নির্ধারণ করে। আর এটি সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় মজুরি বোর্ড হলেও শ্রমিকদের পক্ষে কেউ কথা বলে না। এমনকি সরকারও শ্রমিকদের পক্ষে থাকে না। সরকার মালিকদের চাপের মুখে শ্রমিকের স্বার্থ পুরোপুরি চায় না। তাই শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়। কিন্তু তাতেও তাদের চাহিদাকে আমলে নেয়া হয় না। বরং দেখা যাচ্ছে শ্রমিকদের জীবনহানি হচ্ছে। শ্রমিকদের আন্দোলন বন্ধ করার জন্য সহিংস পথ অবলম্বন করা হচ্ছে। নিজের ঘাম আর শ্রমের বিনিময়ে পরিবার নিয়ে জীবনধারণের জন্য একটু বাড়তি মজুরি চাইতে গিয়ে জীবনটাই যদি চলে যায়—এর চেয়ে করুণ ঘটনা আর কী হতে পারে?
মালিক পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা বিশ্ববাজারে বেশি দাম পাচ্ছেন না। এজন্য দাবি মোতাবেক বেতন বাড়াতে পারছেন না। এ ব্যাপারে কী বলবেন?
যদি পোশাক কারখানার মালিকরা মুনাফা করতে না পারে তাহলে তাদের বিশ্ব ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষিতে যেতে হবে। বাংলাদেশের আর সস্তা শ্রমিকের দেশ হিসেবে বিশ্বে প্রতিযোগিতা করা উচিত নয়। সস্তা শ্রমের পরিচয় নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দীর্ঘদিন টিকে থাকা যাবে না। কারণ শ্রমিককে ন্যায্য মজুরি দেয়া শ্রম অধিকার এবং কমপ্লায়েন্সের অংশ। কমপ্লায়েন্ট কারখানা মানে তো শুধু ভবনের নিরাপত্তা, আগুন-নিরাপত্তা, সবুজায়ন এসব নয়, শ্রমিকের নিরাপত্তাও এর অংশ। আমরা যদি শ্রম অধিকার আইন বাস্তবায়ন না করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের রফতানি বাধার সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি এবং এভরিথিং বাট আর্মস বা ইবিএর আওতায় বাজার সুবিধা চলে যাবে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটার পরও যদি জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে চাই তাহলে আমাদের শ্রমিকের কল্যাণ, শ্রমিকের নিরাপত্তা, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কিছুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাক খাত কতখানি উন্নতি সাধন করেছে এবং সামনের দিনের প্রস্তুতি কেমন তা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছিল। তারা যে সব ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে তা কিন্তু নয়। কেননা বাংলাদেশ এখনো অনেক ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা তার মধ্যে অন্যতম। পাশাপাশি যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এ খাতের উৎপাদনশীলতাও বাড়াতে হবে। এর জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শ্রমিকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। উন্নত ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরিতে বিনিয়োগ করতে হবে।
আপনারা পোশাকের দাম বাড়ানোর কথা বলছেন? সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব?
আমরা শ্রমিক অসন্তোষ এবং বেতন বাড়ানোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনার ওপর জোর দিয়ে আসছি। এতে করে একে অন্যের মধ্যে আস্থার অভাব কমানো সম্ভব হবে। এ ধরনের আলোচনায় বিদেশী ক্রেতা ও ব্র্যান্ডদেরও আমন্ত্রণ জানানো উচিত যাতে তারা মাঠের বাস্তবতা ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে পারে। তারাও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে। নৈতিক ক্রয় এবং ন্যায্য মূল্য দেয়াটা তাদের নিজেদের কমপ্লায়েন্সের অংশ। ক্রেতারা যেন শুধু সস্তা পোশাক কেনার দিকে নজর না দেন। দেখা যায়, আমাদের নিজেদের পোশাক রফতানিকারকরাই নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে দাম কমিয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করেন। এ ধরনের প্রতিযোগিতা শুধু অসুস্থই নয়, তা শ্রমিকের কল্যাণবিরোধী। কেননা পোশাক কারখানার মালিকরা ক্রেতাদের কাছ থেকে দাম কম পাওয়ার অজুহাতে শ্রমিকদের কম বেতন দেয়ার যুক্তি তুলে ধরেন।
চলমান শ্রমিক আন্দোলন প্রলম্বিত হলে আমাদের কী কী ক্ষতি হতে পারে?
অবশ্যই! শ্রমিক আন্দোলন প্রলম্বিত হলে তো পোশাক শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। কারণ যে অর্ডারগুলো আছে সেগুলো তো সময়মতো পাঠাতে হবে। অর্ডারগুলো সময়মতো পৌঁছতে না পারলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, আমাদের বাজার হাত ছাড়া হতে পারে। মনে রাখতে হবে যে এখানে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ আছে। অনেকেই এ বাজারে ঢুকতে চাচ্ছে। তারা কিন্তু তাকিয়ে আছে কীভাবে বাংলাদেশের জায়গাটা নেবে। সুতরাং এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গেলে আমাদের চলবে না। কারণ এটা তো আমাদের অর্থনীতির একটা মেরুদণ্ড। সুতরাং শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়াটা অত্যাবশ্যক। যাতে তারা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে। আরেকটা বিষয় দেখেছি, যখনই এ মজুরি নির্ধারণের সময় হয় তখনই সেটা প্রলম্বিত হয়। এবার ছয় মাস লেগে গেল মজুরি ঘোষণা করতে করতে। কিন্তু ছয় মাস তো জিনিসপত্রের দাম বসে নেই, মূল্যস্ফীতি বসে নেই। সুতরাং মজুরি ঘোষণার বেলায় কালক্ষেপণ বন্ধ করতে হবে।
সম্প্রতি ১২টি দেশ থেকে পোশাক প্রত্যাহারের খবর এসেছে গণমাধ্যমে। সরকারের পক্ষ থেকে যদিও তা অস্বীকার করা হয়েছে। এ রকম কোনো ঝুঁকি আছে কি?
এটা আমার কাছে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হয়। এর সঙ্গে অন্য কিছু যুক্ত করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এ শিল্পে নতুন নয়। যে রিটেইলার বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনেছে তার সঙ্গে অনেক দিনের ব্যবসা। যখন পোশাক বানানো হয় তখন কাপড়, রঙ, ডিজাইন, বোতাম, চেইন সবই তাদের নমুনা ও চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হয়। হয়তো কোনো একটা অর্ডারে ত্রুটিপূর্ণ পোশাক গেছে। বিশ্বের বড় বড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কিংবা মোবাইল ফোনও তো ত্রুটিপূর্ণ হয়। বাজারে ছাড়ার পর তা বাজার থেকে তুলে ফেলা হয়। ঠিকঠাক করে আবার বাজারে ছাড়া হয়।
সম্প্রতি আপনারা সবুজ কারখানায় রূপান্তর নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। সবুজ কারখানা বলতে আপনারা কী বোঝাচ্ছেন?
সবুজ কারখানার ধারণাটি টেকসই পরিবেশের ধারণা থেকে এসেছে। আজকাল উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন বোঝায় না। উন্নয়নটা কীভাবে হচ্ছে, এটি পরিবেশ নষ্ট করছে কিনা, সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে কিনা, সেগুলো বিবেচনা করতে হয়। কারখানার মধ্যে আলো-বাতাস ঠিকমতো আসছে কিনা, আশপাশে গাছপালা আছে কিনা, কারখানার সামনে জায়গা আছে কিনা, পানি অপচয় রোধে কারখানায় ব্যবহৃত পানি পরিষ্কার করে আবার ব্যবহার করা হয় কিনা, সেগুলো দেখতে হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কারখানায় কী ধরনের জ্বালানি ব্যবহার হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তারা নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়াচ্ছে কিনা। এছাড়া কারখানা থেকে যে দূষিত পানি নদী-নালা-পুকুরে যাচ্ছে তা পরিষ্কার করার জন্য ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) রয়েছে কিনা তাও দেখতে হবে। কারখানা থেকে বের হওয়া পানি যাতে জনপদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না রাখে। শুধু জনপদ নয়, খেয়াল রাখতে হবে যাতে পশুপাখি, কৃষিজমি নষ্ট না হয়। কারখানার মধ্যে যে কাপড় অবশিষ্ট থাকে তা থেকে ধুলো, বালি, ময়লা সৃষ্টি হয়। সেগুলো পুনর্ব্যবহার বা অন্য কিছু তৈরির ব্যবস্থা আছে কিনা, কারখানার বর্জ্য পরিষ্কারের ব্যবস্থা আছে কিনা—মোটা দাগে, এসব কর্মকাণ্ডই সবুজ পোশাক শিল্পের অংশ।
সবুজ কারখানা কী কারণে জরুরি বলে মনে করেন?
সবুজ কারখানা দুটো কারণে জরুরি। একটি হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে আমরা যেসব দেশে পোশাক পাঠাচ্ছি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সে দেশগুলোর অঙ্গীকার। জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বার্ষিক কনফারেন্স আয়োজন করে যেটিকে বলা হয় কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ। সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো ২০২১ সালে কপ২৬-এ প্রতিজ্ঞা করেছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনবে। কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশ ২০৬০ বা ২০৭০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড মানুষের স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিশ্বের দেশগুলোর এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য, কারখানা, নির্মাণ খাত, পরিবহন খাত, কৃষি, জ্বালানি—সর্বত্র কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমানোর উদ্যোগ চলছে। তারই অংশ হিসেবে পোশাক শিল্পের উৎপাদন প্রক্রিয়া, সরবরাহ শৃঙ্খল এবং বাজারজাতের সব ধাপে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রচেষ্টা চলছে। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারেরও প্রতিজ্ঞা রয়েছে কার্বন নিঃসরণ কমানোর, যদিও বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ খুবই কম। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং সর্বোপরি বাজার ধরে রাখার জন্য সবুজায়ন খুবই জরুরি।
সবুজ কারখানার সঙ্গে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ও জড়িত? শ্রমিক যদি সুস্থ না থাকেন তাহলে তিনি কাজ করবেন কীভাবে? সহকর্মীদের অসুস্থ করবেন এমনকি পুরো কারখানার কার্যক্রমও ব্যাহত করবেন। সবুজ কারখানায় তাই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, ভালো খাদ্যের সংস্থান, তার সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও ডে-কেয়ার সুবিধা এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও স্বার্থ সংযুক্ত আছে কি সবুজ কারখানায়?
হ্যাঁ অবশ্যই। শ্রমিকের কল্যাণ সবুজ কারখানায় একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আসলে সবুজ কারখানা টেকসই উন্নয়নের একটি অংশ। টেকসই উন্নয়ন হতে হলে পোশাক খাতকে আরো উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। যাতে রফতানি আয় বাড়ে, শ্রমিকের আয় বাড়ে। এটি টেকসই উন্নয়নের অর্থনৈতিক স্তম্ভ। দ্বিতীয় স্তম্ভটি হচ্ছে পরিবেশের উন্নয়ন। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের লক্ষ্য হলো, প্রাকৃতিক সম্পদ যাতে বিনষ্ট না হয় এবং পরিবেশ দূষণ ও কার্বন নিঃসরণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি না বাড়ে। টেকসই উন্নয়নের আরেকটি স্তম্ভ হচ্ছে মানবসম্পদের সামাজিক উন্নয়ন। অপরিচ্ছন্ন কারখানার ধুলোবালি, ময়লা শ্রমিকদের শ্বাসনালি ও ফুসফুসের সমস্যা সৃষ্টি করে। শ্রমিকের স্বাস্থ্যের কল্যাণ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাছাড়া আরো বিষয় আছে। শ্রমিকের কল্যাণ বলতে তো শুধু এটিই নয়। তাদের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার, শিক্ষার সুযোগ, পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার সুযোগ—এগুলোও টেকসই শিল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ।
সৌজন্যে :বণিক বার্তা