ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। রোবটিক্স বিষয়ক তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিশ্বের সেরা সেরা জার্নালে। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিতে দক্ষ ও আগ্রহী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' কে তিনি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাশাপাশি প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ও সমাজে জেন্ডার বৈষম্য নিরসন বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
প্রশ্ন : এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
লাফিফা জামাল: এবারের প্রতিপাদ্য খুবই সুন্দর এবং সময়োপযোগী হয়েছে। একদিক দিয়ে আমরা প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি, উদ্ভাবনের কথা বলছি।অন্যদিক থেকে জেন্ডার বৈষম্য নিরসনের কথাও বলছি। তথ্য প্রযুক্তি একটা স্কিল। আমাদের সবাইকে প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। হয়তোবা আমরা সবাই আবিষ্কার করতে পারব না, কিন্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান আমাদের প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আপনি যদি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর কতদিন ভোক্তা হয়ে থাকব। এখন সময় এসেছে, আমাদের নিজেদের আবিষ্কার করা দরকার। প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : আমরা যদি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি,তাহলে প্রযুক্তি শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কেমন?
লাফিফা জামিল: মেয়েদের আগ্রহ অনেক বেশি। সময়ের সাথে সাথে এই আগ্রহ বেড়েছে। প্রযুক্তির বিষয়টা এমন যে, এখানে খুব ডেডিকেটেডলি সময় দিতে হয়। এই জায়গায় মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে।
প্রশ্ন : প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে নারীর অংশগ্রহণ কেমন?
লাফিফা জামাল: বর্তমানে আমাদের দেশে ৩০ শতাংশ নারীরা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করছে। যদিও পেশাগত জায়গায় ১০ শতাংশের মত নারীদের পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা যাদের পাই, ক্যারিয়ারে গিয়ে তাদের পাই না। এটা যে শুধু প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানে এমন নয়, সব সেক্টরেই নারী শিক্ষার্থীরা ড্রপ আউট হয়। পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয় না, আবার অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হয়েও পরে নানা কারণে ড্রপ আউট হয় বা চাকরি ছেড়ে দেয়।
প্রশ্ন : সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীদের উপস্থিতি কেমন?
লাফিফা জামাল: সাধারণত এন্ট্রি লেভেল বা মিড লেভেলে আমরা যতটা মেয়েদের পাই, হায়ার লেভেল বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তুলনামূলক ভাবে নারীদের উপস্থিতি কম। যদিও এখন পরিবর্তন হচ্ছে। এখন অনেক সেক্টরেই নারী প্রধান হচ্ছেন। এই জায়গায় পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন কে আরও বেগবান করতে হবে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে একটা মেয়ে ডাক্তার হওয়ার চিন্তা যতটা সহজে চিন্তা করতে পারে, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হওয়ার চিন্তা ততটা করতে পারে না কেন?
লাফিফা জামাল: আমাদের সমাজে কতজন বাবা-মা চান আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হোক। পরিবার থেকেই মেয়েদের এই সাইকোলজি তৈরি হয়। একটা মেয়ে জন্মের পর থেকে শুনে আসে গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং খুব কঠিন। কঠিন সাব্জেক্ট মেয়েদের জন্য নয়- এই যে সামাজিক ট্যাবু, এটা একটা বড় ব্যারিয়ার। অথচ আপনি যখন গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন এতে আপনার ব্রেইনের চর্চা হয়। ব্রেইন তো নারী পুরুষ উভয়ের ই সমান। এখানে তো শক্তি লাগতেছে না। পেশি শক্তিতে হয়তো মেয়েরা কিছুটা পিছিয়ে থাকে। এই ব্যারিয়ার দূর করতে হবে ।
প্রশ্ন : আপনি একদিক দিয়ে একাডেমিশিয়ান অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে, অভিভাবকদের ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেওয়ার পরিবর্তে মেয়েকেও কিনে দেব এই চিন্তাটা এসেছে কি?
লাফিফা জামাল: এই উত্তর টা একটু অন্যভাবে দেই। এই চিন্তার কিন্ত পরিবর্তন ঘটেছে। এটা বেশ আশাব্যঞ্জক। আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই ৫০ ভাগ নারী শিক্ষার্থী ১ম বর্ষে ভর্তি হচ্ছে। যাদের একটা বড় অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসছে। বর্তমানে স্কুল-কলেজে ঝড়ে পড়া কমেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ডিনস অ্যাওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি থাকে। এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ও জিপিএতে মেয়েরাই এগিয়ে থাকছে। ঢাবিসহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে নারী ফ্যাকাল্টির সংখ্যা বাড়ছে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে নারীদের একটা বড় অংশ গার্মেন্টসে কাজ করছে, তাদেরকে কীভাবে প্রযুক্তি সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা যায়?
লাফিফা জামাল: এর জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। গার্মেন্টস মালিকদের এখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। মেয়েরা এখন হাতে কাজ করছে। কিছুদিন পর যখন অটো মেশিনে কাজ শুরু হবে, তখন তারা কাজ হারাবে। সেই কাজ হারানোর আগেই তাদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এই মেয়েগুলো যাতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে কাজ করতে পারে, সে জন্য এখন থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রশ্ন : মফস্বলের স্কুল কলেজে ব্যবহারিকের চেয়ে থিওরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে কি শুরুতেই শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না?
লাফিফা জামাল: এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া টা জরুরি। হয়তোবা দেখা যাচ্ছে যিনি জীববিজ্ঞান পড়াচ্ছেন তার ব্যাকগ্রাউন্ডে জীববিজ্ঞান নয় অন্য কোন সাব্জেক্ট রয়েছে। কম্পিউটার বা আইসিটি যিনি পড়াচ্ছেন তিনি হয়তো কম্পিউটারের ব্যবহার ই জানেন না। ফলে ব্যবহারিক বাদ দিয়ে থিওরি পড়াচ্ছেন।
প্রশ্ন : নারীদের দক্ষ করার কাজে যারা যুক্ত তাদের দাবি প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী তারা পাচ্ছেন না।
লাফিফা জামাল: এটা কেবল প্রযুক্তি নয়, সব সেক্টরের চিত্র। স্কুল কলেজের শিক্ষক হিসেবে আমরা মেয়েদের বেশি দেখতে পাই। তবে এখানে আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আগে কিন্ত উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের অংশ গ্রহণ কম ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা বাড়ছে। ফলে আমি মনে করি সামনে এই সংখ্যা বাড়বে।
প্রশ্ন : নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু?
লাফিফা জামাল: আমি তো মনে করি পরিবারের সাপোর্টটা খুব বেশি দরকার। পারিবারিক ভাবে যদি কোন মেয়ে বাধার সম্মুখীন হয়, তাহলে শুরুতেই মনোবল হারিয়ে ফেলে। তাই পরিবারে পিতা মাতা এবং পরবর্তিতে জীবন সঙ্গীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শ্বশুর বাড়ির মানুষদের ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
প্রশ্ন : প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে নারীদের সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি বাড়বে কি না?
লাফিফা জামাল: আমি তা মনে করি না। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে সাইবার বুলিং বাড়বে বিষয়টা এমন নয়। আপনি যদি সচেতন না হন তাহলে একদিন ব্যবহার করেও বিপদে পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে বুলিং প্রতিরোধ করতে হলে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সমাজেও তো বুলিং হয়, সে জন্য কি আমরা দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। কাজেই বুলিংয়ের ভয়ে প্রযুক্তিতে মেয়েরা আসবে না, আমি তা বিশ্বাস করি না। যত বেশি প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হতে পারবে, ততই বুলিংয়ের সম্ভাবনা কমবে।
প্রশ্ন : কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপদ পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করা গেছে?
লাফিফা জামাল: আমরা কি গণ পরিবহনে নিরাপদ পরিবেশ দিতে পেরেছি? পারি নি। শুধু গণ পরিবহনে কেন, রাতের বেলা যদি আমি হেঁটেও রাস্তায় বের হই, নিজেকে নিরাপত্তা দিতে পারি না। একইভাবে কর্মক্ষেত্রেও শত ভাগ নিরাপদ পরিবেশ এখনও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই উদ্যোগ প্রয়োজন।'
সংগ্রহ : দেশ রূপান্তর