কলকাতায় সাত বছর বয়সী এক কন্যা শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনায় জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে মঙ্গলবার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে দক্ষিণ পূর্ব কলকাতার তিলজলা এলাকায় মঙ্গলবার নতুন করে অশান্তি না ছড়ালেও সেখানে এখনও চাপা উত্তেজনা আর বাড়তি পুলিশ বাহিনী মজুত আছে।
রবিবার রাতে তিলজলার একটি আবাসনের বাসিন্দা ওই কন্যা শিশুটির ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ তাদেরই এক প্রতিবেশীর ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়। তাকে যৌন নির্যাতনের পরে হত্যা করা হয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন প্রিয়ঙ্ক কানুনগো টুইট করেছেন, তিলজলার ঘটনায় তাঁরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
“ওই রাজ্যের ডিজিপি এবং মুখ্য সচিবের কাছে আমরা নোটিশ পাঠাচ্ছি। আমাদের একটি প্রতিনিধিদল এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানবেন,” লেখা হয়েছে টুইটে। ওই হত্যাকাণ্ডের পরের দিন তিলজলা এলাকায় যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে, সেটিও কমিশনের নজরে এসেছে বলে রাজ্য পুলিশকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে। কমিশন স্বত:প্রণোদিত হয়ে একটি মামলাও দায়ের করেছে।
ঘটনার সরেজমিন তদন্তে একটি দলও তারা পাঠাবে বলে জানিয়েছে কমিশন।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই শিশুটির পরিবারকে আড়াই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
তন্ত্রসাধনায় নরবলির বিধান নেই'
পুলিশ বলছে, তারা কন্যা শিশুটিকে হত্যার অভিযোগে ধৃত অলোক কুমারকে জেরা করে উত্তর কলকাতার নিমতলা এলাকার এক তান্ত্রিকের কথা জানতে পেরেছে।
মি. কুমার পুলিশকে জানিয়েছেন যে ওই তান্ত্রিকের পরামর্শেই তিনি নরবলি দিয়েছিলেন তার প্রতিবেশীর সাত বছর বয়সী শিশুটিকে। মি. কুমারের স্ত্রী গর্ভধারণ না করতে পারায় ওই তান্ত্রিকের পরামর্শ নিয়েছিলেন। তিনিই অভিযুক্তকে বলেন যে হিন্দু উৎসব রামনবমীর আগে পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সী কোনও শিশুকন্যাকে বলি দিতে পারলে তার স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসবে।
তন্ত্রসাধনার অন্যতম পীঠস্থান বলে পরিচিত হিন্দু তীর্থক্ষেত্র তারাপীঠের পূজারিরা বলছেন তান্ত্রিক মতে কোথাও নরবলি দেওয়ার বিধান নেই।
তারাপীঠ মন্দিরের অন্যতম প্রধান সেবায়েত তারাময় মুখার্জী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মাঝে মাঝেই সংবাদমাধ্যমে দেখা যায় কোনও ইচ্ছাপূরণের জন্য নরবলি বা শিশু বলি দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু অমানবিক নয়, জঘন্য অপরাধ। তন্ত্রমতে সাধনায় কোথাও নরবলি দেওয়ার বিধান নেই।
“যে সব তান্ত্রিক নরবলি বা শিশু বলি দেওয়ার বিধান দেয়, তারা বুজরুকি করে। তাদের নিশ্চিত অন্য কোনও মতলব আছে। কোনও মানুষকে হত্যা করে কারও ভাল হতে পারে না। এটা কখনই মাতৃ আরাধনা নয়,” বলছিলেন তারাপীঠ মন্দিরের প্রধান সেবায়েত।
পুলিশ জানাচ্ছে ওই শিশুকন্যাকে হত্যা করার পরে তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আলাদা করে নেওয়া হয়, সেগুলি দিয়ে তন্ত্রসাধনা করে পুজো দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ধৃতের।
কীভাবে হারিয়ে যায় শিশুটি?
গত রবিবার সকালে নিজের বাড়ির সামনে থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায় সাত বছর বয়সী ওই কন্যা শিশুটি।
শিশুটির মা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সামনে জানিয়েছেন রবিবার তিনিই মেয়েকে বাড়ির জঞ্জাল ফেলে আসতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরে সে বাড়ি না ফেরায় খোঁজ শুরু হয়।
পুলিশের কাছে খবর দেওয়া হলে তারা সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে নিশ্চিত হন যে জঞ্জাল ফেলে শিশুটি বাড়ির ভেতরেই ঢুকেছে।
কিন্তু ওই আবাসিক ভবনটির ৩২টি ফ্ল্যাটে প্রাথমিক তল্লাশি চালিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় নি তাকে।
এরপরে প্রতিটি ফ্ল্যাটে আবারও চিরুনি তল্লাশি চালানো হয়। অনেক রাতে একতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে শিশুটির বস্তাবন্দী মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সেটি রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের পেছনে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
পুলিশ প্রাথমিক ভাবে জানিয়েছে মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে তাকে মেরে ফেলা হয় এবং তারপরে তার শরীরের বিভিন্ন অংশও ক্ষতবিক্ষত করা হয়। হত্যার আগে তার ওপরে যৌন নির্যাতনও চালানো হয়।
যার ফ্ল্যাট থেকে তিলজলা এলাকার বাসিন্দা ওই শিশুটির মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই অলোক কুমারকে গ্রেপ্তার করা হলেও পুলিশ আরও আগে শিশুটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করলে তাকে বাঁচানো যেত, এই অভিযোগ তুলে সোমবার দিনভর পুরো এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়।
রেল, রাস্তা অবরোধ হয়, পুলিশের গাড়ি, মোটরসাইকেল, দমকলের গাড়ী ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীদের হঠাতে পুলিশ লাঠি চার্জ করে আর কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায়।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অন্তত ২০ জনকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে।