পঞ্চাশ বছর পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার। ইমাজীং টাইগার অব এশিয়া আগামীতে হয়ে উঠবে ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমির দেশ। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের নিরন্তর প্রয়াসে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হচ্ছে।
বাঙলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ এবং তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততার বিষয়াশয় নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিএফও) মোহাম্মদ শোয়েব।
মোহাম্মদ শোয়েব, একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। দায়িত্ব পালন করছেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) হিসেবে। তিনি বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের একজন ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর।
প্রশ্ন : আমরা যখন কথা বলছি, সে-সময় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে ইমার্জীং টাইগার অব এশিয়া হিসেবে আবির্ভূত এবং একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার। এ বিষয়ে আপনার নাগরিক স্বপ্ন ও ভাবনাটি জানতে চাইছি?
মোহাম্মদ শোয়েব : এটি সত্যি আনন্দের এবং প্রশংসাযোগ্য যে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে শত বাধা-প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। ছোট্ট ভূখন্ডে প্রায় ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশ ‘এমার্জিং টাইগার অব এশিয়া’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক গেজেটভুক্ত হয়েছি। আর ২০৩১ সাল নাগাদ আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো। এটি আশাবাদের বিষয় যে, এফবিসিসিআই’র ৫০ বছরপূর্তিতে যে বিজনেস সামিট হয়েছিল তাতে আগামীতে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হবে বাংলাদেশ। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সাহসী ও সংগ্রামশীল প্রয়াসে দেশে তৈরি পোশাক’সহ বহুবিধ শিল্প খাতের অবদান জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। এটি আশাবাদের কথা।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল এক অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রামশীলতায় কতদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ? কতটা সাফল্য পেয়েছে? অর্জনগুলো কী?
মোহাম্মদ শোয়েব : বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর যে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে, তাতে আমরা বহু অর্জনে সমৃদ্ধ হয়েছি। যদিও পুরোপুরি গোটা জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবুও আশাবাদী, বিশাল এক তরুণ জনগোষ্ঠী আছে আমাদের তাদেরকে সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জটি রয়েছে আমাদের সামনে। উন্নয়নের হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে লক্ষ্যে কীভাবে কবে পৌঁছুতে পারবো- সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়।
প্রশ্ন : এতো সাফল্য ও সম্ভাবনার পরও আপনি সংকটের কথা ও চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন- বিষয়টি একটু পরিষ্কার করবেন।
মোহাম্মদ শোয়েব : সংকটের বিষয় হলো যে, শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ থেকে যাচ্ছে কর্মসংস্থানের বাইরে। এবং কর্মসম্পৃক্ততার সুযোগ না হওয়ায় তারা অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ পাচ্ছেন না। ফলে বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে—এটিকে আমি গুরুত্বপূর্ণ সংকট বলে মনে করছি। তারুন্য শক্তির আধার। একে যদি ইতিবাচক কর্মসম্পৃক্ততায় ও সঠিক দিক-নিদেশনায় চালিত করা না যায় তাহলে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হবে এবং সমাজ অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠবে- এই আশঙ্কা আমরা কী উড়িয়ে দিতে পারি!
প্রশ্ন : এর মানে তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তোলা এবং তাদের ইতিবাচক কর্মসম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়া জরুরি মনে করছেন আপনি। তো বিশাল সম্ভাবনাময় তরুণ জনগোষ্ঠীকে আমরা কীভাবে সুযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারি?
মোহাম্মদ শোয়েব : ডেমোগ্রাফিক ডিভেডেন্ড পিরিয়ড অতিক্রম করছি আমরা অর্থাৎ প্রবীনদের তুলনায় বিশাল কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে; সেই স্বপ্নের নির্মাণে তারুণ্যকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। ফলে তরুণ প্রজন্মকে সময়োপযোগী শিক্ষা ও কর্মদক্ষতায় গড়ে তোলার পাশাপাশি সমৃদ্ধ বোধ ও চেতনায় লালিত করার বিকল্প নেই। এবং এ ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি—ভাবনাটি এ কারণেই।
দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি আসলে বেকারত্ব তৈরি করে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হারে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ আছে শীর্ষ অবস্থানে। এটি সত্যি গভীর সংকটের বিষয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কার করতে হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কর্মদক্ষতা তৈরির উপযুক্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালুর কোনো বিকল্প নেই। সেই সাথে তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক ও উন্নত চেতনার সমৃদ্ধ মানস গড়ে তোলার জন্য সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিতে হবে—বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন : আপনি একজন চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট। সমৃদ্ধ এক ক্যারিয়ার গড়ে নিয়েছেন আপনি এবং বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের আর্থীক ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। এ বিষয়ে বলুন।
মোহাম্মদ শোয়েব : সবকিছুরই জন্য শুকরিয়া। চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট হওয়ার স্বপ্নটি একদা আমার মধ্যে লালিত হয়েছিল এবং নিরন্তর প্রয়াসে আমি লক্ষ্যে পৌঁছুতে পেরেছি। ফলে শিল্প ও সেবাখাতের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজমেন্টে সম্পৃক্ত থেকে অবদান রাখার মতো দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে নিতে পেরেছি। বর্তমানে এসআইবিএল ব্যাংকের চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
এই পদে থেকে আমাকে বিনিয়োগকারী বোর্ড পরিচালক, ক্লায়েন্ট ডিমান্ড এবং অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাপনার প্রত্যাশা পূরণ করার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রে সফলতার সাথে তা আমি করে যেতে পারছি। চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট না হলে এই বয়সে এতো বড় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া মোটেও সম্ভব হতো বলে মনে করি না।
প্রশ্ন : তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ ও অনুপ্রেরণার কথা জানাবেন।
মোহাম্মদ শোয়েব : তরুণদের উদ্দেশ্যে আমার প্রথম কথাটি হলো তারা যেন সময়ের মূল্য দিতে শিখে এবং নিজেদের লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে পরিশ্রমী ও সংগ্রামশীল হয়। তাদেরকে এটি উপলব্ধি করতে হবে যে, কঠিন এক প্রতিযোগিতামূলক বাস্তবতার মধ্যদিয়ে তাদেরকে যেতে হচ্ছে এবং আগামীতে এই চ্যালেঞ্জ আরও বড় হয়ে দেখা দিবে। সুতরাং জ্ঞান ও কর্মদক্ষতায় সমৃদ্ধ ও সুযোগ্য হওয়া ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প দেখছি না।
তারা চাইলে, চাটার্ড একাউন্টিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বছর তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রয়াসের মধ্যদিয়ে যেতে হবে সত্যি। কিন্তু এরপর তারা যখন চূড়ান্তভাবে এটি সম্পন্ন করবে তখন তাদের সামনে সম্ভাবনা বহু দ্বার খুলে যাবে। চাকরিতে এলে তারা শুরুতেই সিক্স ডিজিটের সেলারি পাবে এবং আনুষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধাতো থাকছেই। এছাড়া সনদপ্রাপ্ত একাউন্ট্যান্ট হিসেবে কনসালটেন্সি ব্যবসায় কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে নেয়ার সুযোগ তো রয়েছেই। এছাড়া, যেহেতু এটি আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে সে কারণে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগটি থাকছে অবারিত। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও পদবীতে থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ সামনে নিয়ে আসবে চাটার্ড একাউন্টিংয়ে গড়া ক্যারিয়ার।
সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যেসব তরুণ-তরুণী নিজেদের তৈরি করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তারা চাইলে চাটার্ড একাউন্টিং বেছে নিতে পারে। এটি উদ্যোক্তা হয়ে উঠবার ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে রাখবে—এটিও নিশ্চিতভাবে বলা যায়।